পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী এইসঙ্গে একটি কথা তোমাদের মনে করতে হবে, যে লোকের সিংহদ্বারে তোমরা সকলে আমীয় বলে আমাকে আজ অভ্যর্থনা করতে এসেছি, এ লোকে তোমাদের জীবনও প্রতিষ্ঠালাভ করেছে, নইলে আমাকে তোমরা আপনার বলে জানতে পারতে না । এই আশ্রমটি তোমাদের দ্বিজত্বের জন্মস্থান । কানাগুলি যেমন পরস্পরের অপরিচিত নানা সুদূর শিখর থেকে নিঃসৃত হয়ে একটি বৃহৎ ধারায় সম্মিলিত হয়ে নদীজন্ম লাভ করে- তোমাদের ছোটাে ছোটো জীবনের ধারাগুলি তেমনি কত দূরদূরান্তর গৃহ থেকে বেরিয়ে এসেছেতারা এই আশ্রমের মধ্যে এসে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে একটি সম্মিলিত প্রশস্ত মঙ্গলের গতি প্ৰাপ্ত হয়েছে। ঘরের মধ্যে তোমরা কেবল ঘরের ছেলেটি বলে আপনাদের জানতে- সেই জানার সংকীর্ণতা ছিন্ন করে এখানে তোমরা সকলের মধ্যে নিজেকে দেখতে পােচ্ছ- এমনি করে নিজের মহত্তর সত্তাকে এখানে উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছ, এই হচ্ছে তোমাদের নবজন্মের পরিচয় । এই নবজন্মে। বংশগীেরব নেই, আত্মাভিমান নেই, রক্তসম্বন্ধের গণ্ডি দেই, আত্মাপরের কোনো সংকীর্ণ ব্যবধান নেই ; এখানে তিনিই পিতা হয়ে, প্ৰভু হয়ে আছেন— যা একঃ, যিনি এক- অবর্ণ, ধার জাতি নেই- বর্ণন অনেকান নিহিতার্থে দধীতি, যিনি অনেক বর্ণের অনেক নিগৃঢ়নিহিত প্রয়োজনসকল বিধান করছেন- বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদীে, বিশ্বের সমস্ত আরম্ভেও যিনি পরিণামেও যিনি- স দেবঃ, সেই দেবতা। সি নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু । তিনি আমাদের সকলকে মঙ্গলবুদ্ধির দ্বারা সংযুক্ত করুন। এই মঙ্গললোকে স্বাৰ্থ বুদ্ধি নয়, বিষয়বুদ্ধি নয়, এখানে আমাদের পরস্পরের যে যোগসম্বন্ধ সে কেবলমাত্র সেই একের বোধে অনুপ্রাণিত মঙ্গলবুদ্ধির দ্বারাই उgद । Sd Sar SvSa শ্রাবণসন্ধ্যা আজ শ্রাবণের অশ্রান্ত ধারাবর্ষণে জগতে আর যত কিছু কথা আছে, সমস্তকেই ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে। মাঠের মধ্যে অন্ধকার আজ নিবিড়- এবং যে কখনো একটি কথা কইতে জানে না, সেই মুক আজ কথায় ভরে উঠেছে। অন্ধকারকে ঠিকমতো তার উপযুক্ত ভাষায় যদি কেউ কথা কওয়াতে পারে, তবে সে এই শ্রাবণের ধারাপতনধ্বনি । অন্ধকারের নিঃশব্দতার উপরে এই ঝরঝর কলশব্দ যেন পদার উপরে পদ টেনে দেয়, তাকে আরো গভীর করে ঘনিয়ে তোলে, বিশ্বজগতের নিদ্রাকে নিবিড় করে আনে। বৃষ্টিপতনের এই অবিরাম শব্দ, এ যেন শব্দের অন্ধকার । আজ এই কর্মহীন সন্ধ্যাবেলাকার অন্ধকার তার সেই জপের মন্ত্রটিকে খুঁজে পেয়েছে। বার বার তাকে ধ্বনিত করে তুলছে- শিশু তার নূতনশেখা কথাটিকে নিয়ে যেমন অকারণে অপ্রয়োজনে ফিরে ফিরে উচ্চারণ করতে থাকে সেইরকম- তার শ্রান্তি নেই, শেষ নেই, তার আর বৈচিত্র্য নেই। আজ বোবা সন্ধ্যাপ্ৰকৃতির এই-যে হঠাৎ কণ্ঠ খুলে গিয়েছে এবং আশ্চর্য হয়ে স্তব্ধ হয়ে সে যেন ক্ৰমাগত নিজের কথা নিজের কানেই শুনছে, আমাদের মনেও এর একটা সাড়া জেগে উঠেছে- সেও কিছু একটা বলতে চাচ্ছে ।- ঐরকম খুব বড়ো করেই বলতে চায়, ঐরকম জল স্থল আকাশ একেবারে ভরে দিয়েই বলতে চায়- কিন্তু সে তো কথা দিয়ে হবার জো নেই, তাই সে একটা সুরকে খুঁজছে। জলের কল্লোলে, বনের মর্মরে, বসন্তের উচ্ছাসে, শরতের আলোকে, বিশাল প্ৰকৃতির যা-কিছু কথা সে তো স্পষ্ট কথায় নয়সে কেবল আভাসে ইঙ্গিতে, কেবল ছবিতে গানে । এইজন্যে প্রকৃতি যখন আলাপ করতে থাকে, তখন সে আমাদের মুখের কথাকে নিরস্ত করে দেয়, আমাদের প্রাণের ভিতরে অনির্বচনীয়ের আভাসে ভরা গানকেই জাগিয়ে তোলে । কথা জিনিসটা মানুষেরই, আর গানটা প্রকৃতির কথা সুস্পষ্ট এবং বিশেষ প্রয়ােজনের দ্বারা সীমাবদ্ধ