পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@° রবীন্দ্র-রচনাবলী যিনি সুখকর তাকেও নমস্কার, যিনি মঙ্গলকর তাকেও নমস্কার ; যিনি সুখের আকর তাকেও নমস্কার, যিনি মঙ্গলের আকর তাকেও নমস্কার ; যিনি মঙ্গল তাকে নমস্কার, যিনি চরমমঙ্গল তাকে নমস্কার । সংসারে পিতা ও মাতার ভেদ আছে কিন্তু বেদের মন্ত্রে যাঁকে পিতা বলে নমস্কার করছে, তার মধ্যে পিতা ও মাতা দুইই এক হয়ে আছে। তাই তাকে কেবল পিতা বলেছে। সংস্কৃতসাহিত্যে দেখা গেছে, পিতরেী বলতে পিতা ও মাতা উভয়কেই একত্রে বুঝিয়েছে। মাতা পুত্রকে একান্ত করে দেখেন— তীর পুত্র তার কাছে আর-সমস্তকে অতিক্রম করে থাকে । এইজন্যে তাকে দেখাশোনা, তাকে খাওয়ানো পরানো সাজানো নাচানো, তাকে সুখী করানোতেই মা মুখ্যভাবে নিযুক্ত থাকেন। গর্ভে সে যেমন তার নিজের মধ্যে একমাত্ররূপে পরিবেষ্টিত হয়ে ছিল, বাইরেও তিনি যেন তার জন্যে একটি বৃহত্তর গর্ভবাস তৈরি করে তুলে পুত্রের পুষ্টি ও তুষ্টির জন্যে সর্বপ্রকার আয়োজন করে থাকেন । মাতার এই একান্ত স্নেহে পুত্র স্বতন্ত্রভাবে নিজের একটি বিশেষ মূল্য যেন অনুভব করে । কিন্তু পিতা পুত্রকে কেবলমাত্র তার ঘরের ছেলে করে তাকে একটি সংকীর্ণ পরিধির কেন্দ্ৰস্থলে একমাত্র করে গড়ে তোলেন না । তাকে তিনি সকলের সামগ্ৰী, তাকে সমাজের মানুষ করে তোেলবার জন্যেই চেষ্টা করেন । এইজন্যে তাকে সুখী করে তিনি স্থির থাকেন না, তাকে দুঃখ দিতে হয় । সে যদি একমাত্র হত, নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ হত, তা হলে সে যা চায় তাই তাকে দিলে ক্ষতি হত না ; কিন্তু তাকে সকলের সঙ্গে মিলনের যোগ্য করতে হলে তাকে তার অনেক কামনার সামগ্ৰী থেকে বঞ্চিত করতে হয়- তাকে অনেক কাদাতে হয় । ছোটাে হয়ে না থেকে বড়ো হয়ে ওঠবার যে দুঃখ তা তাকে না দিলে চলে না । বড়ো হয়ে সকলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই সে-যে সত্য হবে- তার সমস্ত শরীর ও মন, জ্ঞান, ভাব ও শক্তি সমগ্রভাবে সাৰ্থক হবে এবং সেই সার্থকতাতেই সে যথার্থ মুক্তিলাভ করবে- এই কথা বুঝে কঠোর শিক্ষার ভিতর দিয়ে পুত্রকে মানুষ করে তোলাই পিতার কর্তব্য হয়ে ওঠে । ঈশ্বরের মধ্যে এই মাতা পিতা এক হয়ে আছে। তাই দেখতে পাই, আমি সুখী হব বলে জগতে আয়োজনের অন্ত নেই । আকাশের নীলিমা এবং পৃথিবীর শ্যামলতায় আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়- যদি নাও যেত। তবু এই জগতে আমাদের বাস অসম্ভব হত না । ফলে শস্যে আমাদের রসনার তৃপ্তি হয়- যদি নাও হত। তবু প্ৰাণের দায়ে আমাদের পেট ভরাতেই হত । জীবনধারণে কেবল-যে আমাদের বা প্ৰকৃতির প্ৰয়োজন তা নয়, তাতে আমাদের আনন্দ ; শরীরচালনা করতে আমাদের আনন্দ, চিন্তা করতে আমাদের আনন্দ, কাজ করতে আমাদের আনন্দ, প্ৰকাশ করতে আমাদের আনন্দ । আমাদের সমস্ত প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য এবং রসের যোগ আছে । তাই দেখতে পাই, বিশ্বচেষ্টার বিচিত্র ব্যাপারের মধ্যে এ চেষ্টাও নিয়ত রয়েছে যে, জগৎ চলবে, জীবন চলবে এবং সেইসঙ্গে আমি পদে পদে খুশি হতে থাকব । নক্ষত্ৰলোকের যে-সমস্ত প্রয়োজন তা যতই প্ৰকাণ্ড প্রভূত ও আমার জীবনের পক্ষে যতই সুদূরবতী হােক-না কেন, তবুও নিশীথের আকাশে আমার কাছে মনোহর হয়ে ওঠাও তার একটা কাজ । সেইজন্য অতবড়ো অচিন্তনীয় বিরাট কাণ্ডও প্রয়োজনবিহীন গৃহসজ্জার মতো হয়ে উঠে আমাদের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ আকাশমণ্ডপটিকে চুমকির কাজে খচিত করে তুলেছে। এমনি পদে পদে দেখতে পাচ্ছি, জগতের রাজা আমাকে খুশি করবার জন্য তার বহুলক্ষ যোজনান্তরেরও অনুচর-পরিচরদের হুকুম দিয়ে রেখেছেন ; তাদের সকল কাজের মধ্যে এটাও তারা ভুলতে পারে না। এ জগতে আমার মূল্য সামান্য নয়। কিন্তু সুখের আয়োজনের মধ্যেই যখন নিঃশেষে প্রবেশ করতে চাই, তখন আবার কে আমাদের হাত চেপে ধরে, বলে যে, “তোমাকে বদ্ধ হতে দেব না। এই সমস্ত সুখের সামগ্ৰীীর মধ্যে ত্যাগী হয়ে, মুক্ত হয়ে তোমাকে থাকতে হবে, তবেই এই আয়োজন সার্থক হবে । শিশু যেমন গৰ্ভ থেকে মুক্ত হয়ে তবেই যথার্থভাবে সম্পূর্ণভাবে সচেতনভাবে তার মাকে পায়, তেমনি এই সমস্ত সুখের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন মঙ্গললোকে মুক্তিলোকে ভূমিষ্ঠ হবে, তখনই সমস্তকে পরিপূর্ণরূপে পাবে। যখনই আসক্তির পথে যাবে তখনই সমগ্রকে হারাবার পথেই যাবে- বস্তুকে যখনই চোখের উপরে টেনে আনবে, তখনই তাকে আর দেখতে পাবে না, তখনই চোখ অন্ধ হয়ে যাবে ।”