পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ነ ዓo রবীন্দ্র-রচনাবলী আস্বাদ পেয়ে চিরদিন যুবারা যৌবনকে চরমরূপে পাবার আকাঙক্ষা করেছে। প্ৰবীণরা তাই দেখে হোসেছে। মনে করেছে। যুবারা এই সমস্ত নিয়ে ভুলে আছে কেমন করে । ত্যাগের মধ্যে রিক্ততার মধ্যে যে বাধাহীন পরিপূর্ণতা, সেই অমৃতের স্বাদ এরা পায় নি। তিনি চিরপুরাতন যিনি পরমানন্দে আপনাকে নিয়তই ত্যাগ করেছেন, যিনি কিছুই চান না ; তিনিই বৃদ্ধের বন্ধু হয়ে পূর্ণতার দ্বারস্বরূপ যে-ত্যাগ, অমৃতের দ্বারস্বরূপ যে-মৃত্যু, তারই অভিমুখে আপনি হাতে ধরে নিয়ে চলেছেন । এমনি করে অনন্ত যদি পদে পদেই আমাদের কাছে না। ধরা দিতেন, তবে অনন্তকে আমরা কোনো কালেই ধরতে পারতুম না। তবে তিনি আমাদের কাছে না হয়েই থাকতেন। কিন্তু পদে পদে তিনিই আমাদের ‘ই’ । বাল্যের মধ্যে যে ই সে তিনিই, সেইখানেই বল্যের সৌন্দর্য ; যৌবনের মধ্যে যে ই সেও তিনিই, সেইখানেই যৌবনের শক্তি সামর্থ ; বার্ধকের মধ্যে যে হাঁ সেও তিনিই, সেইখনেই বার্ধক্যের চরিতার্থতা । খেলার মধ্যেও পূর্ণরূপে তিনি, সংগ্রহের মধ্যেও পূর্ণরূপে তিনি এবং ত্যাগের মধ্যেও পূর্ণরূপে তিনি। এইজন্যেই পথও আমাদের কাছে এমন রমণীয়, এইজন্যে সংসারকে আমরা ত্যাগ করতে চাই নে । তিনি যে পথে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন । পথের উপর আমাদের এই-যে ভালোবাসা, এ তারই উপর ভালোবাসা । মরতে আমরা যে এত অনিচ্ছা করি, এর মধ্যে আমাদের মনের এই কথাটি আছে যে, “হে প্ৰিয়, জীবনকে তুমি আমাদের কাছে প্রিয় করে রেখেছি। ’- ভুলে যাই, যিনি প্রিয় করেছেন, মরণেও তিনিই আমাদের সঙ্গে চলেছেন । আমাদের বলবার কথা এ নয় যে এটা অপূর্ণ ওটা অপূর্ণ, অতএব এ-সমস্তকে আমরা পরিত্যাগ করব । আমাদের বলবার কথা হচ্ছে এই যে, এরই মধ্যে যিনি পূর্ণ তাকে আমরা দেখব । ক্ষেত্ৰকে বড়ো করেই যে আমরা পূর্ণকে দেখি তা নয়, পূর্ণকে দেখলেই আমাদের ক্ষেত্র বড়ো হয়ে যায়। আমরা যেখানেই আছি, যে অবস্থায় আছি, সকলের মধ্যে যদি তাকে দেখবার অবকাশ না থাকত, তা হলে কেউ কোনো কালেই তাকে দেখবার আশা করতে পারতুম না। কারণ, আমরা যে যতদূরই অগ্রসর হই-না, অনন্ত যদি ধরা না দেন। তবে কোনো কৌশলে কারও তাকে নাগাল পাবার সম্ভাবনা কিছুমাত্র থাকে না । কিন্তু তিনি অনন্ত বলেই সর্বত্রই ধরা দিয়েই আছেন- এইজন্যে তার আনন্দরূপের অমৃতরূপের প্রকাশ সকল দেশে, সকল কালে । তার সেই প্রকাশ যদি আমাদের মানবজীবনের মধ্যে দেখে থাকি তবে মৃত্যুর পরেও তাকে নূতন করে দেখতে পাব, এই আশা আমাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মানবজীবনে সে সুযোগ যদি না ঘটে থাকে, অর্থাৎ যদি না জেনে থাকি যে, যা কিছু প্রকাশ পাচ্ছে সে তারই আনন্দ, তবে মৃত্যুর পরে যে আরো-কিছু বিশেষ সুযোগ আছে, এ কথা কল্পনা করবার কোনো হেতু দেখি নে । অনন্ত চিরদিনই সকল দেশে সকল কালে সকল অবস্থাতেই নিজেকে আমাদের কাছে প্ৰকাশ করবেন, এই তার আনন্দের লীলা । কিন্তু তার যে অন্ত নেই, এ কথা তিনি আমাদের কেমন করে জানান ? নেতি নেতি করে জানান না, ইতি ইতি করেই জানান। অন্তহীন ইতি । সেই ইতিকে কোথাও সুস্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেই এ কথা জানতে পারি, সর্বত্রই ইতি- সর্বত্রই সেই এষঃ । জীবনেও সেই এষঃ, জীবনের পরেও সেই এষঃ । কিন্তু তিনি নাকি অন্তহীন, সেইজন্যে তিনি কোথাও কোনোদিন পুরাতন নন ; চিরদিনই র্তাকে নূতন করেই জানব, নূতন করেই পাব, র্তাতে নূতন করেই আনন্দলাভ করতে থাকব। একেবারেই সমস্ত পাওয়াকে মিটিয়ে দিয়ে চিরকালের মতো একভাবেই যদি তাকে পেতুম, তা হলে অনন্তকে পাওয়া হত না । অন্য সমস্ত পাওয়াকে শেষ করে দিয়ে তবে তাকে পাব, এ কখনো হতেই পারে না । কিন্তু সমস্ত পাওয়ার মধ্যেই কেবল নব নবতর রূপে তাকেই পেতে থাকিব, সেই অন্তহীন এককে অন্তহীন বিচিত্রের মধ্যে চিরকাল ভোগ করে চলাব, এই যদি না হয় তবে দেশকালের কোনো অর্থই নেই- তবে বিশ্বরচনা উন্মত্ত প্ৰলাপ এবং আমাদের জন্মমৃত্যুর প্রবাহ মায়ামরীচিকমাত্র। Sy Ske yoya