পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢ዒ S রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকে জানিয়ে দিলে, নিখিলের ভিতর দিয়ে যে যোগের সূত্র তাকে বেঁধেছে, সেটি কেবল প্ৰাকৃতিক কার্যকারণের সূত্র নয়, সে একটি আন্তীয়তার সূত্র। সেই চিরন্তন আত্মীয়তা পিতামাতার মধ্যে রূপগ্রহণ করে জীবনের আরম্ভেই শিশুকে এই জগতে প্ৰথম অভ্যর্থনা করে নিলে । একেবারেই যে অপরিচিত, এক নিমেষেই তাকে সুপরিচিত বলে গ্রহণ করলে- সে কে ? এমনটা পারে কে ? এ শক্তি আছে কার ? সেই অনন্ত প্ৰেম, যিনি সকলকেই চেনেন, এবং সকলকেই চিনিয়ে দেন । এইজন্যে প্রেম যখন চিনিয়ে দেন, তখন জনাশুনা চেনাপরিচয়ের দীর্ঘ ভূমিকার কোনো দরকার হয় না, তখন রূপগুণ শক্তিসামর্থের আসবাব-আয়োজনও বাহুল্য হয়ে ওঠে, তখন জ্ঞানের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওজন করে হিসেব করে চিনতে হয় না । চিরকাল তার যে চেনাই রয়েছে সেইজন্যে তার আলো যেখানে পড়ে সেখানে কেউ কাউকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে না। শিশু মা-বাপের কোলেই জগৎকে যখন প্ৰথম দেখলে, তখন কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে না- বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের থেকে একটি ধ্বনি এল, ‘এসো, এসো ।” সেই ধ্বনি মা-বাপের কণ্ঠের ভিতর দিয়ে এল কিন্তু সে কি মা-বাপেরই কথা । সেটি র্যার কথা তাকেই মানুষ বলেছে ‘পিতা নোহসি ।” শিশু জন্মাল আনন্দের মধ্যে, কেবল কাৰ্যকারণের মধ্যে নয়। তাকে নিয়ে মা-বাপের খুশি, মা বাপকে নিয়ে তার খুশি । এই আনন্দের ভিতর দিয়ে জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ আরম্ভ হল। এই-যে আনন্দ, এ আনন্দ ছিল কোথায় ? এ আনন্দ আসে কোথা থেকে ? যে-পিতামাতার ভিতর দিয়ে শিশু একে পেয়েছে, সেই পিতামাতা একে পাবে কোথায় ? এ কি তাদের নিজের সম্পত্তি ? এই আনন্দ জীবনের প্রথম মুহুর্তেই যেখান থেকে এসে পীেছল, সেইখানে মানুষের চিত্ত গিয়ে যখন উত্তীর্ণ হয় তখনই এতবড়ো কথা সে অতি সহজেই বলে, “পিতা নোেহাঁসি- তুমিই আমার পিতা, আমার মাতা ' আমাদের এই মন্দিরের একজন উপাসক আমায় জানিয়েছেন, আজ তার মাতার শ্রাদ্ধাদিন । আমি তাকে বলছি, আজ তার মাতাকে খুব বড়ো করে দেখবার দিন, বিশ্বমাতার সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখবার দিন । মা যখন ইন্দ্ৰিয়বোধের কাছে প্ৰত্যক্ষ ছিলেন, তখন তাকে এতবড়ো করে দেখবার অবকাশ ছিল না । তখন তিনি সংসারে আচ্ছন্ন হয়ে দেখা দিতেন । আজ তার সমস্ত আবরণ ঘুচে গিয়েছে- যেখানে তিনি পরিপূর্ণ সত্য, সেইখানেই আজ তাকে দেখে নিতে হবে। যিনি জন্মদান করে নিজের মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে বিশ্বমাতার পরিচয়সাধন করিয়েছেন, আজ তিনি মৃত্যুর পর্দা সরিয়ে দিয়ে সংসারের আচ্ছাদন ছিন্ন করে সেই বিশ্বজননীর মধ্যে নিজের মাতৃত্বের চিরন্তন মূর্তিটি সন্তানের চক্ষে প্ৰকাশ করে দিন । শ্ৰাদ্ধাদিনের ভিতরকার কথাটি- শ্রদ্ধা । শ্রদ্ধা শব্দের অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস । আমাদের মধ্যে একটি মুঢ়তা আছে ; আমরা চোখে দেখা কানে-শোনাকেই সব চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি । যা আমাদের ইন্দ্ৰিয়বােধের আড়ালে পড়ে যায়, মনে করি, সে বুঝি একেবারেই গেল। ইন্দ্ৰিয়ের বাইরে শ্রদ্ধাকে আমরা জাগিয়ে রাখতে পারি। নে । আমার চোখে-দেখা কানে-শোনা দিয়েই তো আমি জগৎকে সৃষ্টি করিনি যে, আমার দেখাশোনার বাইরে যা পড়বে তাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যাকে চোখে দেখছি, যাকে সমস্ত ইন্দ্ৰিয় দিয়ে জানিছি, সে যার মধ্যে আছে, যখন তাকে চােখে দেখি নে, ইন্দ্ৰিয় দিয়ে জানি নে, তখনও তারই মধ্যে আছে। আমার জানা আর তার জানা তো ঠিক এক সীমায় সীমাবদ্ধ নয় । আমার যেখানে জানার শেষ সেখানে তিনি ফুরিয়ে যান নি। আমি যাকে দেখছি নে, তিনি তাকে দেখছেন- আর তার সেই দেখায় নিমেষ পড়ছে না । সেই অনিমেষ জাগ্ৰত পুরুষের দেখার মধ্যেই আজ মাকে দেখতে হবে। আজ এই শ্ৰদ্ধাটিকে হৃদয়ে জাগ্ৰত করে তুলতে হবে যে, মা আছেন, মা সত্যের মধ্যে আছেন, শোকানলের আলোকেই এই শ্রদ্ধাকে উজ্বল করে তুলতে হবে যে, মা আছেন, তিনি কখনোই হারাতে পারেন না। সত্যের মধ্যে মা চিরকাল ছিলেন বলেই তাকে একদিন পেয়েছি- নইলে একদিনও পেতুম না- এবং সত্যের মধ্যেই মা আছেন বলেই আজও তার অবসান নেই । সত্যের মধ্যেই, অমৃতের মধ্যেই সমস্ত আছে, এ কথা আমরা পরমায়ীয়ের মৃত্যুতেই যথার্থত উপলব্ধি করি । যাদের সঙ্গে আমাদের মেহপ্রেমের, আমাদের জীবনের গভীর যোগ নেই, তারা আছে কি নেই তাতে