পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዒ\ኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী যে, দিবসের আয়োজনটি যেখানে যেমন ভাবে অ্যাজ ছিল, সমস্ত রাত্রির অন্ধকার ও অচেতনতার পরেও ঠিক তাকে সেই জায়গাতেই তেমনি করেই কাল পাওয়া যাবে । কেননা সর্বত্র সামঞ্জস্য আছে ; এই অতি প্ৰকাণ্ড অপরিচিত জগৎকে আমরা এই বিশ্বাসেই প্ৰতি মুহুর্তে বিশ্বাস করি । অথচ এই সামঞ্জস্য তো সহজ সামঞ্জস্য নয়- এ তো মেষে ছাগে সামঞ্জস্য নয়, এ যেন বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খাওয়ানো । এই জগৎক্ষেত্রে যে-সব শক্তির লীলা, তাদের যেমন প্ৰচণ্ডতা তেমনি তাদের বিরুদ্ধতা- কেউ-বা পিছনের দিকে টানে, কেউ-বা সামনের দিকে ঠেলে, কেউ-বা গুটিয়ে আনে, কেউ-বা ছড়িয়ে ফেলে, কেউ-বা বজমুষ্টিতে সমস্তকে তাল পাকিয়ে নিরেট করে ফেলবার জন্যে চাপ দিচ্ছে, কেউ-বা তার চক্রযন্ত্রের প্রবল আবর্তে সমস্তকে গুড়িয়ে দিয়ে দিগ্বিদিকে উড়িয়ে ফেলবার জন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সমস্ত শক্তি অসংখ্যবেশে এবং অসংখ্যাতালে ক্রমাগতই আকাশময় ছুটে চলেছে- তার বেগ, তার বল, তার লক্ষ্য, তার বিচিত্ৰতা আমাদের ধারণাশক্তির অতীত ; কিন্তু এই সমস্ত প্রবলতা, বিরুদ্ধতা, বিচিত্ৰতার উপরে অধিষ্ঠিত অবিচলিত অখণ্ড সামঞ্জস্য । আমরা যখন জগৎকে কেবল তার কেনো একটিমাত্র দিক থেকে দেখি তখন গতি এবং আঘাত এবং বিনাশ দেখি, কিন্তু সমগ্রকে যখন দেখি তখন দেখতে পাই নিস্তব্ধ সামঞ্জস্য । এই সামঞ্জস্যই হচ্ছে র্তার স্বরূপ যিনি শান্তংশিবমদ্বৈতম। জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শান্তম, সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শিবম, আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি অদ্বৈতম। " আমাদের আত্মার যে সত্যসাধনা তার লক্ষ্যও এই দিকে, এই পরিপূর্ণতার দিকে- এই শান্ত শিব অদ্বৈতের দিকে, কখনোই প্ৰমত্ততার দিকে নয়। আমাদের যিনি ভগবান তিনি কখনোই প্ৰমত্ত নন। ; নিরবচ্ছিন্ন সৃষ্টিপরম্পরার ভিতর দিয়ে অনন্ত দেশ ও অনন্তকাল এই কথারই কেবল সাক্ষ্য দিচ্ছে : এষ সেতুবিধরণো লোকানামসম্ভেদায় । এই অপ্ৰমত্ত পরিপূর্ণ শান্তিকে লাভ করবার অভিপ্ৰায় একদিন এই ভারতবর্ষের সাধনার মধ্যে ছিল । । উপনিষদে ভগবদগীতায় আমরা এর পরিচয় যথেষ্ট পেয়েছি। মাঝখানে ভারতবর্ষে বৌদ্ধযুগের যখন আধিপত্য হল, তখন আমাদের সেই সনাতন পরিপূর্ণতার সাধনা নির্বাণের সাধনার আকার ধারণ করল । স্বয়ং বুদ্ধের মনে এই নির্বাণ শব্দটির অর্থ যে কী ছিল, তা এখানে আলোচনা করে কোনো ফল নেই, কিন্তু দুঃখের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে শূন্যতার মধ্যে বঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করাই যে চরম সিদ্ধি, এই ধারণা বৌদ্ধযুগের পর হতে নানা আকারে ন্যূনাধিক পরিমাণে সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গিয়েছে । এমনি করে পূর্ণতার শান্তি একদিন শূন্যতার শান্তি আকারে ভারতবর্ষের সাধনাক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল। সমস্ত বাসনাকে নিরস্ত করে সমস্ত প্ৰবৃত্তির মূলোচ্ছেদ করে দিয়ে তবেই পরম শ্রেয়কে লাভ করা যায়, এই মত যেদিন থেকে ভারতবর্ষে তার সহস্ৰ মূল বিস্তার করে দাড়ালো, সেইদিন থেকে ভারতবর্ষের সাধনায় সামািজস্যের স্থলে রিক্ততা এসে দাড়ালো- সেইদিন থেকে প্রাচীন তাপসাশ্রমের স্থলে আধুনিক কালের সন্ন্যাসাশ্রম প্রবল হয়ে উঠল এবং উপনিষদের পূর্ণস্বরূপ ব্ৰহ্ম শঙ্করাচার্যের শূন্যস্বরূপ ব্ৰহ্মরূপে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধবাদে পরিণত হলেন । কেবলমাত্র কঠোর চিন্তার জোরে মানুব নিজের বাসনা ও প্রবৃত্তিকে মুছে ফেলে জগদব্ৰহ্মাণ্ডকে বাদ দিয়ে শরীরের প্রাণক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করে একটি গুণলেশহীন অবচ্ছিন্ন (abstract) সত্তার ধ্যানে নিযুক্ত থাকতেও পারে, কিন্তু দেহমনহাদয়বিশিষ্ট সমগ্ৰ মানুষের পক্ষে এরকম অবস্থায় অবস্থিতি করা অসম্ভব এবং সে তার পক্ষে কুখনোই প্রার্থনীয় হতে পারে না। এই কারণেই তখনকার জ্ঞানীরা যাকে মানুষের চরম শ্ৰেয় বলে মনে করতেন, তাকে সকল মানুষের সাধ্য বলে গণ্যই করতেন না । এই কারণে এই শ্ৰেয়ের পথে তারা বিশ্বসাধারণকে আহবান করতেই পারতেন না- বরঞ্চ অধিকাংশকেই অনধিকারী বলে ঠেকিয়ে রাখতেন এবং এই সাধারণ লোকেরা মূঢ়ভাবে যে-কোনো বিশ্বাস ও সংস্কারকে আশ্রয় করত, তাকে তারা সকরুণ অবজ্ঞাভরে প্রশ্ৰয় দিতেন । যেখানে যেটা যেমনভাবে আছে ও চলছে তাই নিয়েই সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট থাকুক। এই তাদের কথা ছিল- কারণ, সত্য মানুষের পক্ষে এতই সুদূর, এতই দরধিগম্য এবং সত্যকে পেতে গেলে নিজের স্বভাবকে মানুষের এমনি সম্পূর্ণ বিপর্যন্ত করে দিতে হয় !