পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (፩ ዓ S জ্ঞান যখন তাকে পেতে চায় এবং বাক্য প্রকাশ করতে চায় তখন বার বার ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু আনন্দ দিয়ে যখন সেই আনন্দের যোগ হয় তখন সেই প্রত্যক্ষ যোগে সমস্ত ভয় সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যায়। আনন্দের মধ্যে সমস্ত বোধের পরিপূর্ণতা- মন ও হৃদয়ের, জ্ঞান ও ভক্তির অখণ্ড যোগ । আনন্দ যখন জাগে তখন সকলকে সে আহবান করে ; সে গণ্ডির মধ্যে আপনাকে নিয়ে আপনি রুদ্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে না । সে এ কথা কাউকে বলে না যে “তুমি দুর্বল, তোমার সাধ্য নেই, কেননা আনন্দের কাছে কোনো কঠিনতাই কঠিন নয়- আনন্দ সেই আনন্দের ধনকে এতই একান্ত করে এতই নিবিড় করে দেখে যে, সে তাকে দুস্তপ্রাপ্য বলে কোনাে লোককেই বঞ্চিত করতে চায় না- পথ যত দীর্ঘ যত দুৰ্গম হােক-না, এই পরমলাভের কাছে সে কিছুই নয় । । এই কারণে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যে-কোনো মহাত্মা আনন্দ দিয়ে তাকে লাভ করেছেন, তারা অমৃতভাণ্ডারের দ্বার বিশ্বজনের কাছে খুলে দেবার জন্যেই দাড়িয়েছেন— আর র্যারা কেবলমাত্র জ্ঞান বা কেবলমাত্র আচারের মধ্যে নিবিষ্ট, তারাই পদে পদে ভেদবিভেদের দ্বারা মানুষের পরস্পর মিলনের উদার ক্ষেত্ৰকে একেবারে কণ্টকাকীর্ণ করে দেন । তারা কেবল না-এর দিক থেকে সমস্ত দেখেন, হঁহা-এর দিক থেকে নয়- এইজন্যে তাদের ভরসা নেই, মানুষের প্রতি শ্ৰদ্ধা নেই এবং ব্ৰহ্মকেও তারা নিরতিশয় শূন্যতার মধ্যে নির্বাসিত করে রেখে দেন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চিত্তে যখন ধর্মের ব্যাকুলতা প্রবল হল তখন তিনি যে অনন্ত নেতি-নেতিকে নিয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, কিন্তু তিনি যে সেই ব্যাকুলতার বেগে সমাজের পরিবারের চিরসংস্কারগত অভ্যন্ত পথে তার ব্যথিত হৃদয়কে সমৰ্পণ করে দিয়ে কোনোমতে তার কান্নাকে থামিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন নি এইটেই বিস্ময়ের বিষয় । তিনি কাকে চাচ্ছেন তা ভালো করে জািনবার পূর্বেই তাকেই চেয়েছিলেন- জ্ঞান র্যাকে চিরকালই জানতে চায় এবং প্ৰেম র্যাকে চিরকালই পেতে থাকে । এইজন্য জীবনের মধ্যে তিনি সেই ব্ৰহ্মকে গ্ৰহণ করলেন- পরিমিত পদার্থের মতো করে যাকে পাওয়া যায় না এবং শূন্যপদার্থের মতো যাকে না-পাওয়া যায় না- র্যাকে পেতে গেলে এক দিকে জ্ঞানকে খর্ব করতে হয় না, অন্য দিকে প্ৰেমকে উপবাসী করে মারতে হয় না- যিনি বস্তুবিশেষের দ্বারা নির্দিষ্ট নন অথবা বস্তুশূন্যতার দ্বারা অনির্দিষ্ট নন-ধার সম্বন্ধে উপনিষদ বলেছেন যে “যে র্তাকে বলে আমি জানি সেও তাকে জানে না, যে বলে আমি জানি নে সেও তাকে জানে না- এক কথায় র্যার সাধনা হচ্ছে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যের उादन्म | র্যারা মহর্ষির জীবনী পড়েছেন তঁরা সকলেই দেখেছেন, ভগবৎপিপাসা যখন তার প্রথম জাগ্রত হয়ে উঠেছিল তখন কিরকম দুঃসহ বেদনার মধ্যে র্তার হৃদয়কে তরঙ্গিত করে তুলেছিল। অথচ তিনি যখন ব্ৰহ্মানন্দের রসাস্বাদ করতে লাগলেন তখন তাকে উদ্দাম ভাবোন্মাদে আত্মবিস্মৃত করে দেয় নি। কারণ, তিনি র্যাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি শান্তম শিবম অদ্বৈতাম- তার মধ্যে সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত প্ৰেম অতলস্পর্শ পরিপূর্ণতায় পর্যাপ্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে বিশ্বচরাচর শক্তিতে ও সৌন্দর্যে নিত্যকাল তরঙ্গিত হচ্ছে- সে তরঙ্গ সমুদ্রকে ছাড়িয়ে চলে যায় না, এবং সমুদ্র সেই তরঙ্গের দ্বারা আপনাকে উদবোল করে তোলে না। র্তার মধ্যে অনন্ত শক্তি বলেই শক্তির সংযম এমন অটল, অনন্ত রস বলেই রসের গভীর্য এমন অপরিমেয়। এই শক্তির সংযমে এই রসের গভীর্যে মহর্ষি চিরদিন আপনাকে ধারণ করে রেখেছিলেন, কারণ, ভুমার মধ্যেই আত্মাকে উপলব্ধি করবার সাধনা তার ছিল । র্যারা আধ্যাত্মিক অসংযমকেই আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় বলে মনে করেন তারা এই অবিচলিত শান্তির অবস্থাকেই দারিদ্র্য বলে কল্পনা করেন, তারা প্ৰমত্ততার মধ্যে বিপর্যন্ত হয়ে পড়াকেই ভক্তির চরম অবস্থা বলে জানেন । কিন্তু যারা মহর্ষিকে কাছে থেকে দেখেছেন, বস্তুত যারা কিছুমাত্র তার পরিচয় পেয়েছেন, তারা জানেন যে তার প্রবল সংযম ও প্রশান্ত গভীৰ্য ভক্তিরসের দীনতাজনিত নয় । প্ৰাচীন ভারতের তপোবনের ঋষিরা যেমন তার গুরু ছিলেন, তেমনি পারস্যের সৌন্দৰ্যকুঞ্জের বুলবুল হাফেজ তার বন্ধু ছিলেন। তার জীবনের আনন্দ প্ৰভাতে উপনিষদের শ্লোকগুলি ছিল প্ৰভাতের আলোক এবং হাফেজের কবিতাগুলি ছিল প্ৰভাতের গান । হাফেজের কবিতার মধ্যে যিনি