পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (ነbrዒ করে তুলে ধরে এই কথাটি স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের আশ্রমের প্রতিদিনের সাধনার লক্ষ্যটি এই যে, বিশ্বের সকল স্পর্শে আমাদের জীবনের সকল তার বাজতে থাকবে অনন্তের আনন্দগানে । সংকোচ নেই ; কোথাও সংকোচ নেই, কোথাও কিছুমাত্র সংকোচ নেই- স্বার্থের সংকোচ, ক্ষুদ্র সংস্কারের সংকোচ, ঘূণাবিদ্বেষের সংকোচ— কিছুমাত্র না । সমস্ত অত্যন্ত সহজ, অত্যন্ত পরিষ্কার, অত্যন্ত খোলা, সমস্তই আলোতে ঝলমল করছে- তার উপর বিশ্বাপতির আঙুল যখন যেমনি এসে পড়ছে, অকুষ্ঠিত সুর তৎক্ষণাৎ ঠিকটি বেজে উঠছে। জড় পৃথিবীর জলস্থলের সঙ্গেও তার আনন্দ সাড়া দিচ্ছে, তরুলতার সঙ্গেও তার আনন্দ মর্মরিত হয়ে উঠছে, পশুপক্ষীর সঙ্গেও তার আনন্দের সুর মিলছে, মানুষের মধ্যেও তার আনন্দ কোনো জায়গায় প্রতিহত হচ্ছে না ; সকল জাতির মধ্যে, সকলের সেবার মধ্যে, সকল জ্ঞানে, সকল ধর্মে তার উদার আত্মবিস্মৃত আনন্দ সূর্যের সহস্র কিরণের মতো অনায়াসে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। সর্বত্রই সে জাগ্ৰত, সে সচেতন, সে উন্মুক্ত ; প্রস্তুত তার দেহ মন, উন্মুক্ত তার দ্বার বাতায়ন, উচ্ছসিত তার আহবান ধ্বনি । সে সকলের, এবং সেই বিশ্বরাজপথ দিয়েই সে তার যিনি সকলেরই । হে অমৃত আনন্দময়, আমার এই ক্ষুদ্র আমিটুকুর মধ্যে তোমার অনন্ত অমৃত আনন্দরূপ দেখবার জন্যে অপেক্ষা করে আছি । কতকাল ধরে যে, তা আমি নিজেও জানি নে, কিন্তু অপেক্ষা করে আছি । যতদিন নিজেকে ক্ষুদ্র বলে জানিছি, ছোটাে চিন্তায় ছােটাে বাসনায় মৃত্যুর বেষ্টনের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি, ততদিন তোমার অমৃতরূপ আমার মধ্যে প্রত্যক্ষ হচ্ছে না। ততদিন আমার দেহে দীপ্তি নেই, মনে নিষ্ঠা নেই, কর্মে ব্যবস্থা নেই, চরিত্রে শক্তি নেই, চারি দিকে শ্ৰী নেই ; ততদিন তোমার জগদব্যাপী নিয়মের সঙ্গে শৃঙ্খলার সঙ্গে, সৌন্দর্যের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে না। যতদিন আমার এই আমিটুকুর মধ্যে তোমার অনন্ত অমৃতরূপ আনন্দরূপ না উপলব্ধি করছি, ততদিন আমার ভয়ের অন্ত নেই, শোকের অবসান নেই ; ততদিন মৃত্যুকেই চরম ভয় বলে মনে করি, ক্ষতিকেই চরম বিপদ বলে গণ্য করি ; ততদিন সত্যের জন্যে সংগ্ৰাম করতে পারি নে, মঙ্গলের জন্যে প্ৰাণ দিতে কুষ্ঠিত হই ; ততদিন আত্মাকে ক্ষুদ্র মনে করি বলেই কৃপণের মতো আপনাকে কিন্তু সত্য বঁচিয়ে চলি নে, ধর্ম বঁচিয়ে চলি নে, আত্মার সম্মান বঁাচিয়ে চলি নে । যতদিন আমার এই আমিটুকুর মধ্যে তোমার অনন্ত অমৃতরূপ আনন্দরাপ না দেখি ততদিন চারি দিকের অনিয়ম, অস্বাস্থ্য, অজ্ঞান, অপূর্ণতা, অসৌন্দর্য, অপমান আমার জড়চিত্তকে আঘাতমাত্র করে না— চতুর্দিকের প্রতি আমার সুগভীর আলস্যবিজড়িত অনাদর দূর হয় না, নিখিলের প্রতি আমার আত্মা পরিপূর্ণ শক্তিতে প্রসারিত হতে পারে না ; ততদিন পাপকে বিমুগ্ধ বিহবলভাবে অন্তরের মধ্যে দিনের পর দিন কেবল লালন করেই চলি এবং পাপকে উদাসীন দুর্বলভাবে বাহিরে দিনের পর দিন কেবল প্রশ্রয় দিতেই থাকি- কঠিন এবং প্রবল সংকল্প নিয়ে অকল্যাণের সঙ্গে সংগ্ৰাম করবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে দাড়াতে পারি নে, কি অব্যবস্থাকে কি অন্যায়কে আঘাত করার জন্যে প্ৰস্তুত হই নে, পাছে তার লেশমাত্র প্রতিঘাত নিজের উপরে এসে পড়ে । তোমার অনন্ত অমৃতরূপ আনন্দরাপ। আমার এই আমিটুকুর মধ্যে বোধ করতে পারি। নে বলেই ভীরুতার অধম ভীরুতা এবং দীনতার অধম দীনতার মধ্যে দিনে দিনে তলিয়ে যেতে থাকি, দেহে-মনে গৃহে-গ্রামে সমাজে-স্বদেশে সর্বত্রই নিদারুণ নৈম্বফল্য মঙ্গলকে পুনঃ পুনঃ বাধা দিতে থাকে, এবং অতি বীভৎস আচল জড়ত্ব ব্যাধিরূপে দুৰ্ভিক্ষরূপে, অনাচার ও অন্ধ সংস্কাররূপে, শতসহস্ৰ কাল্পনিক বিভীষিকারাপে, অকল্যাণ ও শ্ৰীহীনতাকে চারি দিকে তৃপাকার করে তোলে। হে ভুমা, আজকের এই উৎসবের দিন আমাদের জাগরণের দিন হােক— আজ তোমার এই আকাশে আলোকে বাতাসে উদবোধনের বিপুল বাণী উদগীত হতে থাক, আমরা অতি দীর্ঘ দীনতার নিশাবসানে নেত্র উমীলন করে জ্যোতির্ময় লোকে নিজেকে অমৃতস্য পুত্ৰাঃ বলে অনুভব করি ; আনন্দসংগীতের তালে তালে নিৰ্ভয়ে যাত্ৰা করি সত্যের পথে, আলোকের পথে, অমৃতের পথে ; আমাদের এই যাত্রার পথে আমাদের মুখে চক্ষে, আমাদের বাক্যে মনে, আমাদের সমস্ত কর্মচেষ্টায়, হে রুদ্র, তোমার প্রসন্নমুখের জ্যোতি উদভাসিত হয়ে উঠুক। আমরা এখানে সকলে যাত্রীর দল- তোমার আশীৰ্বাদ লাভের জন্য দাড়িয়েছি ; সম্মুখে আমাদের পথ, আকাশে নবীন সূর্যের আলোক, সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম।” আমাদের মন্ত্র ; অন্তরে আমাদের