পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এষ ব্ৰহ্মবিদাং বরিষ্ঠঃ । পরমাত্মায় র্যাের আনন্দ, পরমাত্মায় ধার ক্ৰীড়া এবং যিনি ক্রিয়াবান তিনিই ব্ৰহ্মবিদদের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ । আনন্দ আছে অথচ সেই আনন্দের ক্রীড়া নেই, এ কখনো হতেই পারে না— সেই ক্রীড়া নিক্রিয় নয়- সেই ক্রীড়াই হচ্ছে কর্ম। ব্ৰহ্মে যার আনন্দ তিনি কর্ম না হলে বাঁচবেন কী করে ? কারণ, তাকে এমন কর্মকরতেই হবে যে কর্মে সেই ব্ৰহ্মের আনন্দ আকার ধারণ করে বাহিরে প্রকাশমান হয়ে ওঠে । এইজন্য যিনি ব্ৰহ্মবিৎ, অর্থাৎ জ্ঞানে যিনি ব্ৰহ্মকে জানেন, তিনি আত্মরতিঃ, পরমাত্মাতেই তার আনন্দ, তিনি আত্মত্রীড়ঃ, তার সকল কাজই হচ্ছে পরমাত্মার মধ্যে— তার খেলা, তার স্নান-আহার, তার জীবিকা- অর্জন, তার পরহিতসাধন, সমস্তই হচ্ছে পরমাত্মার মধ্যে র্তার বিহার । তিনি ক্রিয়াবান, ব্রহ্মের যে আনন্দ তিনি ভোগ করেন তাকে কর্মে প্ৰকাশ না করে তিনি থাকতে পারেন না । কবির আনন্দ কাব্যে, শিল্পীর আনন্দ শিল্পে, বীরের আনন্দ শক্তির প্রতিষ্ঠায়, জ্ঞানীর আনন্দ তত্ত্বাবিষ্কারে যেমন আপনাকে কেবলই কর্ম-আকারে দ্বারা, শৃঙ্খলার দ্বারা, মঙ্গলের দ্বারা, অসীমকেই প্রকাশ করতে চেষ্টা করে। ব্ৰহ্মও তো আপনার আনন্দকে তেমনি করেই প্রকাশ করছেন ; তিনি ‘বহুধাশক্তিযোগাৎ বর্ণাননেকান নিহিতার্থে দধীতি’ । তিনি আপনার বহুধা শক্তির যোগে নানা জাতির নানা অন্তনিহিত প্রয়োজন সাধন করছেন । সেই অন্তনিহিত প্রয়োজন তো তিনি নিজেই, তাই তিনি আপনাকে নানা শক্তির ধারায় কেবলই নানা আকারে দান করছেন । কাজ করছেন, তিনি কাজ করছেন- নইলে আপনাকে তিনি দিতে পারবেন কী করে । তার আনন্দ আপনাকে কেবলই উৎসর্গ করছে, সেই তো তার সৃষ্টি । আমাদেরও সার্থকতা ঐখানে, ঐখানেই ব্ৰহ্মের সঙ্গে মিল আছে । বহুধাশক্তিযোগে আমাদেরও আপনাকে কেবলই দান করতে হবে । বেদে তাকে ‘আত্মদা বলদা’ বলেছে, তিনি যে কেবল আপনাকে দিচ্ছেন তা নয়, তিনি আমাদের সেই বল দিচ্ছেন যাতে করে আমরাও তার মতো আপনাকে দিতে পারি। সেইজন্যে, বহুধা শক্তির যোগে যিনি আমাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন ঋষি তারই কাছে প্রার্থনা করছেন : স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু। তিনি যেন আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো প্রয়োজনটা মেটান, আমাদের সঙ্গে শুভবুদ্ধির যোগসাধন করেন। অর্থাৎ শুধু এ হলে চলবে না যে, তার শক্তিযোগে তিনি কেবল আপনি কর্ম করে আমাদের অভাব মোচন করবেন ; আমাদের শুভবুদ্ধি দিন, তা হলে আমরাও তার সঙ্গে মিলে কাজ করতে দাড়াব, তা হলেই তার সঙ্গে আমাদের যোগ সম্পূর্ণ হবে। শুভবুদ্ধি হচ্ছে সেই বুদ্ধি যাতে সকলের স্বার্থকে আমারই নিহিতাৰ্থ বলে জানি, সেই বুদ্ধি যাতে সকলের কর্মে আপনি বহুধা শক্তি প্রয়োগ করাতেই আমার আনন্দ । এই শুভবুদ্ধিতে যখন আমরা কাজ করি তখন আমাদের কর্ম, নিয়মবদ্ধ কর্ম, কিন্তু যন্ত্রচালিতের কর্ম নয়আত্মার তৃপ্তিকর কর্ম, কিন্তু অভাবতাড়িতের কর্ম নয়- তখন আমাদের কর্ম দশের অন্ধ অনুকরণ নয়, লোকাচারের ভীরু অনুবর্তন নয় । তখন, যেমন আমরা দেখছি বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদেী, বিশ্বের সমস্ত কর্ম তাতেই আরম্ভ হচ্ছে এবং তাতেই এসে সমাপ্ত হচ্ছে, তেমনি দেখতে পাব আমার সমস্ত কর্মের আরম্ভে তিনি এবং পরিণামেও তিনি- তাই আমার সকল কমই শান্তিময়, কল্যাণময়, আনন্দময় । উপনিষৎ বলেন তার “স্বাভাবিকী জ্ঞানবিলক্রিয়া চ” । তার জ্ঞান শক্তি এবং কর্ম স্বাভাবিক । তার পরমা শক্তি আপন স্বভাবেই কাজ করছে ; আনন্দই তার কাজ, কাজই তার আনন্দ । বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের অসংখ্য ক্রিয়াই তার আনন্দের গতি । কিন্তু সেই স্বাভাবিকতা আমাদের জন্মায় নি বলেই কাজের সঙ্গে আনন্দকে আমরা ভাগ করে ফেলেছি । কাজের দিন আমাদের আনন্দের দিন নয়, আনন্দ করতে যেদিন চাই সেদিন আমাদের ছুটি নিতে হয় । কেননা হতভাগ্য আমরা, কাজের ভিতরেই আমরা ছুটি পাই নে। প্রবাহিত হওয়ার মধ্যেই নদী ছুটি পায়, শিখারূপে জ্বলে ওঠার মধ্যেই আগুন ছুটি পায়, বাতাসে বিত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যেই ফুলের গন্ধ ছুটি পায়আপনার সমস্ত কর্মের মধ্যেই আমরা তেমন করে ছুটি পাই নে। কর্মের মধ্যে দিয়ে আপনাকে ছেড়ে দিই নে বলে, দান করি নে বলে কর্ম আমাদের চেপে রাখে । কিন্তু, হে আত্মদা, বিশ্বের কর্মে তোমার প্ৰত্যক্ষ করে কর্মের ভিতর দিয়ে আমাদের আত্মা আগুনের মতো তোমার দিকেই জ্বলে উঠুক, নদীর মতো তোমার অভিমুখেই প্রবাহিত হােক, ফুলের গন্ধের মতো তোমার মধ্যেই বিত্তীর্ণ হতে থােক। জীবনকে তার