পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Veo S. রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অসীমকে আমার সমস্ত দিয়ে দেখতে পাই নে। মানুষের মধ্যে যখন অসীমের প্রকাশ দেখি তখন আমরা অসীমকে আমার সকল দিক দিয়েই দেখি এবং যে দেখা সকলের চেয়ে অন্তরতম সেই দেখা দিয়ে দেখি । সেই দেখা হচ্ছে ইচ্ছার মধ্যে ইচ্ছাকে দেখতে পাওয়া । জগতের নিয়মের মধ্যে আমরা শক্তিকে দেখতে পাই ; কিন্তু ইচ্ছাশক্তিকে দেখতে গেলে ইচ্ছার মধ্যে ছাড়া আর কোথায় দেখব ? ভক্তের ইচ্ছা যখন ভগবানের ইচ্ছাকে জ্ঞানে প্ৰেমে কর্মে প্ৰকাশ করতে থাকে তখন যে অপরাপ পদার্থ দেখি জগতে সে আর কোথায় দেখতে পাব ? অগ্নি জল বায়ু সূৰ্য তারা যত উজ্জ্বল যত প্রবল যত বৃহৎ হােক এই প্ৰকাশকে সে তো দেখাতে পারে না । তারা শক্তিকে দেখায়, কিন্তু শক্তিকে দেখানোর মধ্যে একটা বন্ধন একটা পরাভব আছে । তারা নিয়মকে রেখামাত্র লঙ্ঘন করতে পারে না । তারা যা তাদের তাই হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই, কেননা তাদের লেশমাত্র ইচ্ছা নেই। এমনতরো জড়যন্ত্রের মধ্যে ইচ্ছার আনন্দ পূর্ণভাবে প্রকাশ হতে *tg: क्रा । মানুষের মধ্যে ঈশ্বর এই ইচ্ছার জায়গাটাতে আপনার সর্বশক্তিমত্তাকে সংহরণ করেছেন- এইখানে তার থেকে তাকে কিছু পরিমাণ স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন ; সেই স্বাতন্ত্র্যে তিনি তঁর শক্তি প্রয়োগ করেন না। কেননা, সেই স্বাধীনতার ক্ষেত্রটুকুতে দাসের সঙ্গে প্রভুর সম্বন্ধ নয়, সেখানে প্রিয়ের সঙ্গে প্রিয়ের মিলন। সেইখানেই সকলের চেয়ে বড়ো প্ৰকাশ-- ইচ্ছার প্রকাশ, প্রেমের প্রকাশ, সেখানে আমরা তাকে মানতেও পারি, না। মানতেও পারি ; সেখানে আমরা তাকে আঘাত দিতে পারি। সেখানে আমরা ইচ্ছাপূর্বক তঁর ইচ্ছাকে গ্ৰহণ করব, শ্ৰীতির দ্বারা তার প্রেমকে স্বীকার করব- সেই একটি মস্ত অপেক্ষা একটি মস্ত ফাক রয়ে গেছে । বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে কেবলমাত্র এই ফঁাকিটুকুতেই সর্বশক্তিমানের সিংহাসন পড়ে নি। কেননা, এইখানে প্রেমের আসন পাতা হবে । এই যেখানে ফাক রয়ে গেছে। এইখানেই যত অসত্য অন্যায় পাপ মলিনতার অবকাশ ঘটেছে ; কেননা, এইখান থেকেই তিনি ইচ্ছা করেই একটু সরে গিয়েছেন । এইখানে মানুষ এতদূর পর্যন্ত বীভৎস হয়ে উঠতে পারে যে, আমরা সংশয় পীড়িত হয়ে বলে উঠি জগদীশ্বর যদি থাকতেন। তবে এমনটি ঘটতে পারত না ; বস্তুত সে জায়গায় জগদীশ্বর আচ্ছন্নই আছেন, সে জায়গা তিনি মানুষকেই ছেড়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে তার নিয়ম একেবারে চলে গেছে তা নয় ; কিন্তু মা যেমন শিশুকে স্বাধীনভাবে চলতে শেখাবার সময় তার কাছে থাকেন। অথচ তাকে ধরে থাকেন না, তাকে খানিকটা পরিমাণে পড়ে যেতে এবং আঘাত পেতে অবকাশ দেন, এও সেই রকম । মানুষের ইচ্ছার ক্ষেত্রটুকুতে তিনি আছেন, অথচ নেই। এইজন্য সেই জায়গাটাতে আমরা এত আঘাত করছি, আঘাত পাচ্ছি, ধুলায় আমাদের সর্বাঙ্গ মলিন হয়ে উঠছে, সেখানে আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের আর অন্ত নেই, সেইখানেই আমাদের যত পাপ । সেইখান থেকেই মানুষের এই প্রার্থনা ধ্বনিত হয়ে উঠছে ; আবিরাবীর্ম এধি। হে প্রকাশ, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক । বৈদিক ঋষির ভাষার এই প্রার্থনাটাই এই বাংলাদেশে পথ চলতে চলতে শোনা যায় এমন গানে যে গান সাহিত্যে স্থান পায় নি, এমন লোকের কণ্ঠে যার কোনো অক্ষরবোধ হয় নি। সেই বাংলাদেশের নিতান্ত সরলচিত্তের সরল সুরের সারি গান : মাঝি, তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না ! তোমার হাল তুমি ধরো, এই তোমার জায়গায় তুমি এসো, আমার ইচ্ছা নিয়ে আমি আর পেরে উঠলুম না। আমার মধ্যে যে বিচ্ছেদটুকু আছে সেখানে তুমি আমাকে একলা বসিয়ে রেখো না । হে প্ৰকাশ, সেখানে তোমার প্ৰকাশ পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক । এত বাধা বিরোধ, এত অসত্য, এত জড়তা, এত পাপ কাটিয়ে উঠে। তবে ভক্তের মধ্যে ভগবানের প্রকাশ সম্পূর্ণ হয়। জড়াজগতে তার প্রকাশের যে বাধা নেই তা নয় ; কারণ, বাধা না হলে প্রকাশ হতেই পারে না। জড়াজগতে তার নিয়মই তার শক্তিকে বাধা দিয়ে তাকে প্রকাশ করে তুলছে ; এই নিয়মকে তিনি স্বীকার করেছেন । আমাদের চিত্তজগতে যেখানে তার প্রেমের মিলনকে তিনি প্ৰকাশ করবেন। সেখানে সেই প্রকাশের বাধাকে তিনি স্বীকার করেছেন, সে হচ্ছে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা । এই বাধার ভিতর দিয়ে যখন প্ৰকাশ সম্পূর্ণ হয়- যখন ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছা, প্রেমের সঙ্গে প্রেম, আনন্দের সঙ্গে আনন্দ মিলে যায়, তখন ভক্তের মধ্যে ভগবানের এমন একটি আবির্ভাব হয় যা আর কোথাও হতে পারে না ।