পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ܬܦܠ যিনি সকলের চেয়ে সত্য তাকেই সকলের চেয়ে সহজে দেখা এই হচ্ছে আমাদের সকল দেখার চরম সাধনা । সেই দেখাটি খুলবে, সেই চোখটি ফুটবে, এইজনেই তো রোজ আমরা দু বেলা তার নাম করছি, তাকে প্ৰণাম করছি। তাকে ডাকতে ডাকতে, তার দিকে মুখ তুলতে তুলতে, ভিতরের সেই শক্তি ক্ৰমে জাগ্রত হবে, বাধা কেটে যেতে থাকবে, আত্মার চোখ খুলে যাবে। যেমনি খুলে যাবে আমনি আর তর্ক নয়, যুক্তি নয়, কিছু নয়- অমনি সহজে দেখা, অমনি আমার মনের আনন্দের সঙ্গে সেই আকাশ-ভরা আনন্দের একেবারে গায়ে গায়ে ঠেকা, অমনি আমার সমস্ত শরীরে তার স্পর্শ, সমস্ত মনে তার অনুভূতি । আমনি তখনই অতি সহজে উপলব্ধি যে, তারই আনন্দে আলোক আমার চোখের তারায় আলো হয়ে নাচছে, তারই আনন্দে বাতাস আমার দেহের মধ্যে প্রাণ হয়ে বয়ে যাচ্ছে। আমনি জানতে পারা যায় যে, এই পৃথিবীর মাটি আমাকে ধরে আছে। এ কথাটি সত্য নয়, তিনিই আমাকে ধরে আছেন ; এই সংসার আমার আশ্রয় এ কথাটি সত্য নয়, তিনিই আমার আশ্রয়। তখন এ কথা বুঝতে কিছু বিলম্ব হবে না যে, আলোক আছে বলে দেখছি তা নয়, তিনিই আমার অন্তরে ও বাইরে সত্য হয়ে আছেন বলেই সমস্ত জিনিসের সঙ্গে আমার দেখার যোগ হচ্ছে, তার শক্তিতেই তাকে দেখছি ; তারই ধী দিয়ে তাকে ধ্যান করছি ; তারই সুরে আমার কণ্ঠ তারই নাম করছে ; তারই আনন্দে আমি তার স্মরণে আনন্দ পাচ্ছি। তাই আমি তোমাদের বলছি, তোমরা জান বা না জানি তোমাদের গভীর আত্মার পরম চাওয়ার ধন হচ্ছেন তিনি । আমাদের এই আমি সেই পরম আমির মুখোমুখি হয়ে না বসতে পারলে কখনোই তার প্ৰেম চরিতার্থ হবে না । আর-সমস্তকে সে ধরছে ছাড়ছে হারাচ্ছে ; তাই সে এমন একটি আমিকে আপনার প্রত্যক্ষ বোধে চাচ্ছে যার মধ্যে সে চিরন্তনরূপে সম্পূর্ণরূপে আছে ; অন্য জিনিসের মতো যাকে ধরতে হয় না, ছুতে হয় না, রাখতে হয় না । আমাদের এই ভিতরকার একলা আমি সেই- যে তার পরম সাথিকে সাক্ষাৎ করে জানতে চায়। তার কান্না কি শুনতে পােচ্ছ না। তাকে আর তুমি পদে পদে ব্যর্থ কোরো না, তার কান্না থামাও । তোমার আপনাকে তুমি আপনি সার্থক করবার জন্যে এসো এসো, প্রতিদিন সাধনায় বোসো। সকালে ঘুম ভেঙেই প্ৰথম কথা যেন মনে পড়ে তিনি আছেন, আমি তার মধ্যে আছি। যদি অর্ধরাত্রে জেগে ওঠ তবে একবার চোখ চেয়ে দেখে মনকে এই কথাটি বলিয়ে নিয়ো যে, তিনি তার সমস্ত লোকলোকান্তরকে নিয়ে অন্ধকারকে পরিপূর্ণ করে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন, আমি তার মধ্যেই আছি। মধ্যাহ্নে কাজ যখন অত্যন্ত উগ্র হয়ে উঠে তোমাকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করে নিয়ে চলেছে তখন মুহুর্তকালের জন্যে আপনাকে থামিয়ে এই কথাটি বোলো- তুমি আছ, আমি তোমার মধ্যে আছি। এমনি করেই সকল সময়ে সকল দেখার মধ্যে সত্যকে দেখা সহজ হয়ে যাবে। প্রতিদিন উপাসনায় যখন তার কাছে বসবে মনকে বিমুখ হতে দিয়ে না । তিনি আছেন, তারই সামনে এসে বসেছি, এই সহজ কথাটি যেন এক মুহুর্তেই মন সহজ করে বলতে পারে ; যেন এক নিমেষেই একেবারেই তোমার মাথা তীর পায়ের কাছে এসে ঠেকে। প্রথম কিছুদিন মন চঞ্চল হতে পারে ; কিন্তু প্ৰতিদিন বসতে বসতে ক্রমেই বসা সত্য হয়ে উঠবে, ক্রমেই তার কাছে পৌঁছতে আর দেরি शद नीं । AE SV) SI শুচি প্রসঙ্গক্রমে আজ দ্বিপ্রহরে আমার একটি পবিত্র বাল্যস্মৃতি মনের মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠেছে। বালক বয়সে যখন একটি খৃস্টান বিদ্যালয়ে আমি অধ্যয়ন করেছিলুম তখন একটি অধ্যাপককে দেখেছিলুম। র্যার সঙ্গে আমার সেই অল্পকালের সংসৰ্গ আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে গেছে। শুনেছিলুম। তিনি স্পেনদেশের একটি সম্রান্ত ধনী বংশীয় লোক, ভোগৈশ্বৰ্য সমস্ত পরিত্যাগ করে ধর্মসাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন । তার পাণ্ডিত্যও অসাধারণ, কিন্তু তিনি তার মণ্ডলীর আদেশক্রমে এই দূর প্রবাসে এক বিদ্যালয়ে নিতান্ত নিম্নশ্রেণীতে অধ্যাপনার কাজ করছেন।