পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VO করছি যে, আমার মধ্যে করণীয় কিছুই নেই। আমাদের যে আত্মপূজা সে একেবারেই দেবতার পূজা নয়, সে অপদেবতার পূজা, সে অত্যন্ত অবজ্ঞার পূজা। আমাদের যা অপবিত্র তাই দিয়েও আমরা নৈবেদ্যকে ভরিয়ে তুলছি। 辑 নিজেকে যে লোক কেবলই ধনমান জোগাচ্ছে সে লোক নিজের সত্যকে কেবলই অবিশ্বাস করছে ; সে আপনার অন্তরের মানুষকে কেবলই অপমান করছে ; তাকে সে কিছুই দিচ্ছে না। কিছু দেবার যোগাই মনে করছে না। এমনি করে সে নিজেকে কেবল অর্থই দিচ্ছে, কিন্তু শ্ৰদ্ধা দিচ্ছে না- এবং শ্রদ্ধয়া দেয়ম। এই উপদেশবাণীটিকে সকলের চেয়ে ব্যৰ্থ করছে নিজের বেলাতেই । কিন্তু সত্যকে আমরা হাজার অস্বীকার করলেও সত্যকে তো আমরা বিনাশ করতে পারি নে। আমাদের অন্তরের সত্য মানুষটিকে আমরা যে চিরদিনই কেবল অভূক্ত রেখে দিচ্ছি ; তার দুৰ্গতি তো কোনো আরামে কোনো আড়ম্বরে চাপা পড়ে না। আমরা যার সেবা করি সে তো আমাদের বাচায় না, আমরা যার ভোগের সামগ্ৰী জুগিয়ে চলি সে তো আমাদের এমন একটি কড়িও ফিরিয়ে দেয় না যাকে আমাদের চিরানন্দপথের সম্বল বলে বুকের কাছে যত্ন করে জমিয়ে রেখে দিতে পারি। আরামের পর্দা ছিন্ন করে ফেলে দুঃখের দিন তো বিনা আহবানে আমাদের সুসজ্জিত ঘরের মাঝখানে হঠাৎ এসে দাড়ায়, তখন তো বুকের রক্ত দিয়েও তার দাবি নিঃশেষে চুকিয়ে মিটিয়ে দিতে পারি। নে ; আর অকস্মাৎ বজের মতো মৃত্যু এসে আমাদের সংসারের মর্মস্থানের মাঝখানটায় যখন মন্ত একটা ফাক রেখে দিয়ে যায় তখন রাশি রাশি ধনজনমান দিয়ে ফাক তো কিছুতে ভরিয়ে তুলতে পারি নে। যখন এক দিকে ভার চাপতে চাপতে জীবনের সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে বাড়তে একদিন যখন বিনাশের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন লোকজন সৈন্যসামন্ত কাকে ডাকব যে তার উপরে এক ঘড়াও জল ঢেলে দিতে পারে। মূঢ়, কাকে প্ৰবল করে তুমি বলী হলে, কাকে ধনদান করে তুমি ধনী হতে পারলে, কাকে প্রতিদিন রক্ষা করে করে তুমি চিরদিনের মতো বেঁচে গেলে ? আমাদের অন্তরের সত্য মানুষটি কোন আশ্ৰয়ের জন্যে পথ চেয়ে আছে ? আমরা এতদিন ধরে তাকে কোন ভরসা দিয়ে এলুম ? বাহিরের বৈঠকখানায় আমরা ঝাড়লণ্ঠন খাটিয়ে দিলুম, কিন্তু অন্তরের ঘরের কোণটিতে আমরা সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালালুম না। রাত্রি গভীর হল, অন্ধকার নিবিড় হয়ে এল, সেই তার একলা ঘরের নিবিড় অন্ধকারের মাঝখানে ধুলায় বসে সে যখন কেঁদে উঠল আমরা তখন প্রহরে প্রহরে কী বলে তাকে আশ্বাস দিলুম। তার সেই মৰ্মভেদী রোদনে আমাদের নিশীথরাক্রির প্রমোদসভায় যখন ক্ষণে ক্ষণে আমাদের বড়োই ব্যাঘাত করতে লাগল, আমাদের মত্ততার মাঝখানে তার সেই গভীর ক্ৰন্দন আমাদের নেশাকে যখন ক্ষণে ক্ষণে ছুটিয়ে দেবার উপক্রম করলে, তখন আমরা তাকে কোনোমতে থামিয়ে রাখবার জন্যে তার দরজার বাহিরে দাড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে তাকে বলে এসেছি— ভয় নেই তোমার, আমি আছি। মনে করেছি। এই বুঝি তার সকলের চেয়ে বড়ো অভয়মন্ত্র যে “আমি আছি। নিজের সমস্ত ধনসম্পদ মনমর্যাদাকে একটা মমতার সূত্রে জপমালার মতো গেঁথে ফেলে তার হাতে দিয়ে বলেছি- এইটােকেই তুমি দিনরাত্রি বার বার করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেবলই একমনে জপ করতে থাকে, “আমি আমি আমি। আমি সত্য, আমি বড়ো, আমি প্রিয়।” তাই নিয়ে সে জপছে বটে ; আমি আমি আমি। কিন্তু, তার চোখ দিয়ে জল পড়া আর কিছুতেই থামছে না। তার ভিতরকার এ কোন একটা মহাবিষাদ অশ্রুবিন্দুর গুটি ফিরিয়ে ফিরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই জপে যাচ্ছে : না না না, নয় নয় নয়। কোন তাপসিনীর করুশবীিণায় এমন উদাসী-করা ভৈরবীর সুরে সমস্ত আকাশকে কঁদিয়ে কঁদিয়ে তুলছে : ব্যর্থ হল, ব্যর্থ হল রে, সকালবেলাকার আলোক ব্যর্থ হল, রাত্ৰিবেলাকার স্তব্ধতা ব্যৰ্থ হল ; মায়াকে খুঁজলুম, ছায়াকে পেলুম, কোথাও কিছুই ধরা দিল না । r ওরে মত্ত, কোন মাভৈঃ বাণীটির জন্যে আমার এই অন্তরের একলা মানুষ এমন উৎকণ্ঠিত হয়ে কান পেতে রয়েছে ? সে হচ্ছে চিরদিনের সেই সত্য বাণী : পিতা নোেহসি, পিতা তুমিই আছ । তুমি আছ, পিতা, তুমি আছ, আমাদের পিতা তুমি আছ- এই বাণীতেই সমস্ত শূন্য ভরে গেল, সমস্ত ভার সরে গেল, কোনো ভয় আর কোথাও রইল না ।