পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VNOV রবীন্দ্র-রচনাবলী আর, ওটা কী ভয়ানক মিথ্যা, ঐ-যে “আমি আছি ! কই আছ, তুমি আছ কোথায় ! তুমি ভাবসমুদ্রের কোন ফেনাগুলাকে আশ্রয় করে বলছি “আমি আছি । যে বুদবুদটি যখনই ফেটে যাচ্ছে তাতে তখনই তোমারই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সংসারে দীর্ঘনিশ্বাসের যে, লেশমাত্র তপ্ত হওয়াটুকু তোমার গায়ে এসে লাগছে। তাতে একেবারে তোমার সত্তাকেই গিয়ে ঘা দিচ্ছে। তুমি আছ কিসের উপরে । তুমি কে । অথচ আমার অন্তরের মানুষ যখন বলছে চাই তখন তুমি অহংকার করে তাকে গিয়ে বলছি: আমি আছি, তুমি আমাকেই চাও, তুমি আমাকে নিয়েই খুশি থাকে। এ তোমার কেমন দান। তোমার প্রকাণ্ড বোঝা বইবে কে। এ যে বিষম ভার। এ যে কেবলই বস্তুর পরে বস্তু, কেবলই ক্ষুধার পরে ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পরে দুৰ্ভিক্ষ । এ তো তোমাকে আশ্রয় করা নয়, এ যে তোমাকে বহন করা। তুমি যে পলু, তোমার যে পা নেই, তুমি যে কেবলই অন্যের উপরেই ভর দিয়ে সংসারে চলে বেড়াও । তোমার এ বোঝা যেখানকার সেইখানেই পড়ে পড়ে ধুলোর সঙ্গে ধুলো হয়ে যেতে থােক ! যে মানুষটি যাত্রী, যে পথের পথিক, অনন্তের অভিমুখে যার ডাক আছে, সে তোমার এই ভার টেনে টেনে বেড়াবে কেন । এই সমস্ত বোঝার উপর দিনরাত্ৰি বুক দিয়ে চেপে পড়ে থাকবে, সে সময় তার কোথায় । এইজন্যে সে তাকেই চায় ধার উপরে সে ভরদিতে পারবে, যার ভার তাকে বইতে হবে না। তুমি কি সেই নির্ভর নাকি । তবে কী ভরসা দেবার জন্যে তুমি তার কানের কাছে এসে মন্ত্র জপছ “আমি আছি ! পিতা নোহসি : পিতা, তুমি আছ, তুমি আছ- এই আমার অন্তরের একমাত্র মন্ত্র । তুমি আছ। এই দিয়েই আমার জীবনের এবং জগতের সমস্ত কিছু পূর্ণ। সত্যং এই বলে ঋষিরা তোমাকে একমনে জপ করেছেন, সে কথাটির মানে হচ্ছে এই যে : পিতা নোেহসি, পিতা তুমি আছ। যা সত্য তা শুধুমাত্র সত্য নয়, তাই আমার পিতা । কিন্তু, তুমি আছ। এই বোধটিকে তো সমস্ত প্ৰাণমন দিয়ে পেতে হবে । তুমি আছ, এ তো শুধু একটা মন্ত্র নয়। তুমি আছ, এটা তো শুধু কেবল একটা জেনে রাখবার কথা নয়। তুমি আছ, এই বোধটিকে যদি আমি পূর্ণ করে না যেতে পারি। তবে কিসের জন্যে এ জগতে এসেছিলুম, কেনই বা কিছুদিনের জন্য নানা জিনিস আকড়ে ধরে ধরে ভেসে বেড়ালুম- শেষকালে কেনইবা এই অসংলগ্ননিরর্থকতার মধ্যে হঠাৎ দিন ফুরিয়ে er শক্ত হয়েছে এই যে, আমি আছি। এই বোধটিকেই আমি দিবারাত্রি সকল রকম করেই অভ্যাস করে ফেলেছি । জীবনের সকল চেষ্টাতেই কেবল এই আমিকেই নানা রকম করে স্বীকার করে এসেছি, প্ৰতিদিনের সমস্ত খাজনা তারই হাতে শেষ কড়াটি পর্যন্ত জমা করে দিয়েছি। আমি-বোধটা একেবারে অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে গেছে, সে যদি বড়ো দুঃখ দেয়। তবু তাকে অন্যমনস্ক হয়েও চেপে ধরি, তাকে ভুলতে ইচ্ছা করলেও ভুলতে পারি নে। সেইজন্যেই আমাদের প্রতিদিনের প্রার্থনা এই যে, পিতা নো বোধি ; তুমি যে পিতা, তুমি যে আছ, এই সত্যের বোধে আমার সমস্ত জীবনকে পূর্ণ করে দাও । পিতা নো বোধি ; পিতার বোধ দিয়ে আমার সমস্তকে সমস্তটা ভরে তোলো, কিছুই আর বাকি না থােক ; আমার প্রত্যেক নিশ্বাস প্রশ্বাস পিতার বোধ নিয়ে আমার সর্বশরীরে প্রাণের আনন্দ তরঙ্গিত করে তুলুক, আমার সর্বাঙ্গের স্পর্শচেতনা পিতার বোধে পুলকিত হয়ে উঠক, পিতার বোধের আলোক আমার দুই চক্ষুকে অভিষিক্ত করে দিক । পিতা নো বোধি ; আমার জীবনের সমস্ত সুখকে পিতার বোধে বিনম্র করে দিক, আমার জীবনের সমস্ত দুঃখকে পিতার বোধ করুশাবর্ষণে সফল । করে তুলুক। আমার ব্যথা, আমার লজ্জা, আমার দৈন্য, সকলের সঙ্গে আমার সমস্ত বিরোধ, পিতার বোধের অসীমতার মধ্যে একেবারে ভাসিয়ে দিই। এই বোধ প্রতিদিন প্রসারিত হতে থােক ; নিকট হতে দূরে, দূর হতে দূরান্তরে, আমীয় হতে পরে, মিত্র হতে শত্রুতে, সম্পদ হতে বিপদে, জীবন হতে মৃত্যুতে প্রসারিত হতে থােক- প্রিয় হতে অপ্রিয়ে, লাভ হতে অ্যাগে, আমার ইচ্ছা হতে তোমার ইচ্ছায়। প্রতিদিন মন্ত্র পড়ে গিয়েছি। “পিতা নো বোধি, কিন্তু একবারও মনেও আনি নি কত বড়ো চাওয়া চাচ্ছি; মনেও আনি নি এই প্রার্থনাকে যদি সত্য করে তুলতে চাই। তবে জীবনের সাধনাকে কত বড়ো সাধনা করতে হবে। কত ত্যাগ, কত ক্ষমা, কত পাপের ক্ষালন, কত সংস্কারের আবরণ-মোচন, কত হৃদয়ের গ্রন্থি-ছেদন ।