পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vb8 S রবীন্দ্র-রচনাবলী তার একটু অংশ দেবে না ? যারা কেড়ে নেবার লোক তারা কেড়ে নেয়, তারা অনাদর সইতে পারে না । আর যিনি দ্বারের বাইরে প্রতীক্ষা করে দাড়িয়ে রয়েছেন তাকেই বলেছি, “তোমাকে দিতে পারব না ।” দিনের পর দিন কি এই কথা বলে আমরা সব ব্যর্থকরিনি। একদিন আমাদের এ সংকল্প নিতেই হবে, বলতে হবে, “আমার ধন জন মান, আমার সমস্ত খ্যাতি-প্রতিপত্তি জীবনযৌবন তোমারই জন্যে ।” প্রতিদিন যদি বা ভুলে থাকি আজ একদিন অন্তত বলি, “তোমারই জন্য আমার এই জীবন হে স্বামী । তোমাকে না দিয়ে কি আমি আমাকে ব্যর্থ করলেম না তোমাকেই ব্যৰ্থ করলেম ? তুমি যে বলেছিলে আমরা অমৃতস্য পুত্রাঃ, আমরা অমৃতের পুত্র । তুমি যে বলেছিলে, তুমি বড়ো, তোমার জীবন সংসারের সুখের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে থাকবে না। সেই পিতৃসত্য যে আমাদের পালন করতেই হবে, তাকে ব্যর্থ করলে যে তোমার সত্যকেই ব্যর্থ করা হবে ।” সেইজন্যে, সেই সত্যকে স্বীকার করবে বলে এক-একটা দিনকে মানুষ পৃথক করে রাখে । সে বলে, রোজ তো ঘানি টেনেছি, আর পারি। নে ; একটা দিন অন্তত বুঝি যে আনন্দলোকে অমৃতলোকেই আমি জন্মগ্রহণ করেছি, কারাগারের মধ্যে নয় । সেই দিন উৎসবের দিন, সেই দিন মানুষের আপনার সত্যকে জানিবার দিন । সেই দিনকে প্রতিদিনকার দিন করতে হবে । প্রতিদিন নিজেকে কত অসত্য করে দেখেছি, কত অসত্য করে জেনেছি ; একদিন আপনাকে অনন্তের মধ্যে দেখে নিতে হবে । বিশ্বের বিধাতা হয়েও তুমি আমার পিতা, পিতা নোহসি, এতবড়ো কথা একদিন সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মাঝখানে দাড়িয়ে জানাতেই হবে । আজি ধনমান খ্যাতিপ্ৰতিপত্তির কাছে প্ৰণাম নয়, প্রতিদিন সেইখানে মাথা লুটিয়েছি। এবং সেই ধূলিজঞ্জালের নীচে কোন তলায় তলিয়ে গিয়েছি। আজ সমস্ত জঞ্জাল দূর করে দিয়ে যিনি আমার দরজায় যুগ যুগ ধরে দাড়িয়ে রয়েছেন তাকে ডাকব ; পিতা নোহসি । তুমি আমার পিতা । যেদিন তাকে ডাকব, তাকে ঘরে নিয়ে আসব, সেদিন সব ধনমান সার্থক হবে, সেদিন কোনো অভাবই আর অভাব থাকবে না । মানুষ একদিন ভেবেছিল সে স্বর্গে যাবে, সেই চিন্তায় সে তীর্থে তীর্থে ঘুরেছে, সে ব্ৰাহ্মণের পদধূলি নিয়েছে, সে কত ব্ৰত অনুষ্ঠান করেছে ; কী করলে সে স্বৰ্গলোকের অধিকারী হতে পারে এই কথাই তার মনে জেগেছে। কিন্তু, স্বৰ্গতো কোথাও নেই। তিনি তো স্বৰ্গ কোথাও রাখেননি। তিনি মানুষকে বলেছেন, তোমাকে স্বৰ্গ তৈরি করতে হবে । এই সংসারকেই তোমায় স্বৰ্গ করতে হবে । সংসারে তঁাকে আনলেই যে সংসার স্বৰ্গ হয়। এতদিন মানুষ এ কোন শূন্যতার ধ্যান করেছে। সে সংসারকে ত্যাগ করে কেবলই দূরে দূরে গিয়ে নিস্ফল আচার বিচারের মধ্যে এ কোন স্বৰ্গকে চেয়েছে। তার ঘর-ভরা শিশু তার মা-বাপ ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-প্রতিবেশী- এদের সকলকে নিয়ে নিজের সমস্ত জীবনখানি দিয়ে-যে তাকে স্বৰ্গ তৈরি করতে হবে । কিন্তু সে সৃষ্টি কি একলা হবে। না, তিনি বলেছেন, “তোমাতে আমাতে মিলে স্বৰ্গ করব, আর-সব আমি একলা করেছি, কিন্তু তোমার জন্যেই আমার স্বৰ্গসৃষ্টি অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তোমার ভক্তি তোমার আত্মনিবেদনের অপেক্ষায় এতবড়ো একটা চরমসৃষ্টি হতে পারে নি।” সৰ্বশক্তিমান এই জায়গায় তার শক্তিকে খর্ব করেছেন, এক জায়গায় তিনি হার মেনেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না তীর সকলের চেয়ে দুর্বল সন্তান তার সব উপকরণ হাতে করে নিয়ে আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বৰ্গরচনাই অসম্পূর্ণ রইল। এইজন্যে যে তিনি যুগ যুগান্ত ধরে অপেক্ষা করছেন। তিনি কি এই পৃথিবীর জন্যেই কত কাল ধরে অপেক্ষা করেন নি । আজ যে এই পৃথিবী এমন সুন্দরী এমন শস্যশ্যামলা হয়েছে, কত বাপদহনের ভিতর দিয়ে ক্রমশ শীতল হয়ে তরল হয়ে তার পরে ক্ৰমে ক্রমে এই পৃথিবী কঠিন হয়ে উঠেছে। তখন তার বক্ষে এমন আশ্চর্য শ্যামলতা দেখা দিয়েছে। পৃথিবী যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে, কিন্তু স্বৰ্গ এখনো বাকি । বাষ্প-আকারে যখন পৃথিবী ছিল তখন তো এমন সৌন্দৰ্য ফোটে নি। আজ নীলাকাশের নীচে পৃথিবীর কী অপরূপ সৌন্দৰ্য দেখা দিয়েছে। ঠিক তেমনি স্বৰ্গলোক বাষ্পপ-আকারে আমাদের হৃদয়ের ভিতরে ভিতরে রয়েছে, তা আজও দানা বেঁধে ওঠে নি। তার সেই রচনাকার্যে তিনি আমাদের সঙ্গে বসে গিয়েছেন ; কিন্তু আমরা কেবল খাব, পরব, সঞ্চয় করব, এই বলে বলে সমস্ত ভুলে বসে রইলুম। তবু এ ভুল তো ভাঙবে ; মরবার আগে একদিন তো বলতে হবে, “এই পৃথিবীতে এই জীবনে আমি স্বর্গের একটুখানি আভাস রেখে গেলেম । কিছু মঙ্গল রেখে গেলেম ।” অনেক অপরাধ তুপাকার হয়েছে, অনেক সময় ব্যর্থ করেছি, তবু ক্ষণে ক্ষণে একটু সৌন্দৰ্য