পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\960 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তপস্যার দ্বারা উপলব্ধি করতে হবে ; কেবলই রসে মজে থাকতে হবে না- জ্ঞানে বুঝতে হবে, কর্মে পেতে হবে, তাকে আমার মধ্যে যেমন আনতে হবে তেমনি আমার শক্তিকে তার মধ্যে প্রেরণ করতে হবে । সেই অনন্তস্বরূপের সম্বন্ধে মানুষ এক দিকে বলেছে আনন্দ হতেই তিনি যা-কিছু সমস্ত সৃষ্টি করছেন, আবার আর-এক দিকে বলেছে : স তপোহতপাত, তিনি তপস্যা দ্বারা যা-কিছু সমস্ত সৃষ্টি করেছেন । এই দুইই একই কালে সত্য। তিনি আনন্দ হতে সৃষ্টিকে উৎসারিত করছেন, তিনি তপস্যাদ্বারা সৃষ্টিকে কালের ক্ষেত্রে প্রসারিত করে নিয়ে চলেছেন । একই কালে তাকে তার সেই আনন্দ এবং তার সেই প্ৰকাশের দিক থেকে গ্ৰহণ না করলে আমরা চাদ ধৱছি কল্পনা করে কেবল আকাশ ধরবার চেষ্টা করব । বহুকাল পূর্বে একবার বৈরাগীর মুখে গান শুনেছিলুম ; আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে ! সে আরো গেয়েছিল ; আমার মনের মানুষ যেখানে, আমি কোন সন্ধানে যাই সেখানে ! তার এই গানের কথাগুলি আজ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন শুনেছি তখন এই গানটিকে মনের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করেছি তা নয়, কিংবা এ কথা আমার জানিবার প্রয়োজন বোধ হয় নি যে যারা গাচ্ছে তারা সাম্প্রদায়িক ভাবে এর ঠিক কী অর্থ বোঝে । কেননা, অনেক সময় দেখা যায় মানুষ সত্যভাবে যে কথাটা বলে মিথ্যাভাবে সে কথাটা বোঝে । কিন্তু, এ কথা ঠিক যে এই গানের মধ্যে মানুষের একটি গভীর অন্তরের কথা প্ৰকাশ হয়ে পড়েছে। মানুষের মনের মানুষ তিনিই তো, নইলে মানুষ কার জোরে মানুষ হয়ে উঠছে। ইহুদিদের পুরাণে বলেছে ঈশ্বর মানুষকে আপনার প্রতিরূপ করে গড়েছেন । স্কুল বাহ্য ভাবে এ কথার মানে যেমনই হােক, গভীর ভাবে এ কথা সত্য বৈকি । তিনি ভিতরে থেকে আপনাকে দিয়েই তো মানুষকে তৈরি করে তুলছেন । সেইজন্যে মানুষ আপনার সাব-কিছুর মধ্যে আপনার চেয়ে বড়ো একটি কাকে অনুভব করছে। সেইজন্যেই ঐ বাউলের দলই বলেছে : খাচার মধ্যে অচিন পাখি কমনে আসে যায় ! আমার সমস্ত সীমার মধ্যে সীমার অতীত সেই অচেনাকে ক্ষণে ক্ষণে জানতে পারছি, সেই অসীমকেই আমার করতে পারবার জন্যে প্ৰাণের ব্যাকুলতা - আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে ! অসীমের মধ্যে যে একটি ছন্দ দূর ও নিকট -রূপে আন্দোলিত, যা বিরাট হৃৎস্পন্দনের মতো চৈতন্যধারাকে বিশ্বের সর্বত্র প্রেরণ ও সর্বত্র হতে অসীমের অভিমুখে আকর্ষণ করছে, এই গানের মধ্যে সেই ছন্দের দোলাটুকু রয়ে গেছে । অনন্তস্বরূপ ব্ৰহ্ম অন্য জগতের অন্য জীবের সঙ্গে আপনাকে কী সম্বন্ধে বেঁধেছেন তা জানিবার কোনো ! উপায় আমাদের নেই, কিন্তু এইটুকু মনের ভিতরে জেনেছি যে মানুষের তিনি মনের মানুষ ; তিনিই মানুষকে পাগল করে পথে বের করে দিলেন, তাকে স্থির হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দিলেন না। কিন্তু, সেই মনের মানুষ তো আমার এই সামান্য মানুষটি নয় ; তঁাকে তো কাপড় পরিয়ে, আহার করিয়ে, শয্যায় শুইয়ে, ভোগের সামগ্ৰী দিয়ে ভুলিয়ে রাখবার নয় । তিনি আমার মনের মানুষ বটে, কিন্তু তবু দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতে হচ্ছে ; আমার মনের মানুষ কে রে ! আমি কোথায় পাব তারে ! সে যে কে তা তো আপনাকে কোনো সহজ অভ্যাসের মধ্যে স্কুল রকম করে ভুলিয়ে রাখলে জানতে পারব না। তাকে জ্ঞানের সাধনায় জানতে হবে ; সে জানা কেবলই জানা, সে জানা কোনোখানে এসে বদ্ধ হবে না । কোথায় পাব তারে ! কোনো বিশেষ নির্দিষ্ট স্থানে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে তো পাওয়া যাবে না ; স্বার্থবিন্ধন মোচন করতে করতে, মঙ্গলকে সাধন করতে করতেই তাকে পাওয়া ; আপনাকে নিয়ত দানের দ্বারাই তাকে নিয়ত পাওয়া । মানুষ এমনি করেই তো আপনার মনের মানুষের সন্ধান করছে। এমনি করেই তো তার সমস্ত দুঃসাধ্য সাধনার ভিতর দিয়েই যুগে যুগে সেই মনের মানুষ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে। যতই তাকে পাচ্ছে ততই বলছে “আমি কোথায় পাব তারে । সেই মনের মানুষকে নিয়ে মানুষের মিলন বিচ্ছেদ একাধারেই ; তাকে পাওয়ার মধ্যেই তাকে না-পাওয়া । সেই পাওয়া না-পাওয়ার নিত্য টানেই মানুষের নব নব ঐশ্বর্যােলাভ, জ্ঞানের অধিকারের ব্যাপ্তি, কর্মক্ষেত্রের প্রসার- এক কথায়, পূর্ণতার মধ্যে অবিরত আপনাকে নব নব রূপে উপলব্ধি । অসীমের সঙ্গে মিলনের মাঝখানেই এই-যে একটি চিরবিরহ আছে। এ বিরহ তো কেবল রসের