পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Ve? ভেবে দেখো, মানুষকে কি অমৃতের পুত্র করে তোলা সহজ । মানুষের বিকাশে যত বাধা ফুলের বিকাশে তত বাধা নেই । সে যে খোলা আকাশে থাকে ; সমস্ত আলোকের ধারা বাতাসের ধারা নিয়ত সেই আকাশ ধুয়ে দিচ্ছে- সে বাতাসে তো দূষিত বাষ্প জমা হয়ে তাকে বিষাক্ত করছে না, মুহুর্তে মুহুর্তে আকাশ-ভরা প্ৰাণ সেই বিষকে ক্ষালন করে দিচ্ছে, তাকে কোথাও জমতে দিচ্ছে না । মানুষের মুশকিল হয়েছে, সে আপনার সংস্কার দিয়ে আপনার চারি দিকে একটা আবরণ উঠিয়েছে ; কত যুগের কত আবর্জনাকে সে জমিয়ে জমিয়ে তুলেছে। সে বলে, “আকাশের আলোকে আমি বিশ্বাস করব না, আমার ঘরে মাটির দীপকে আমি বিশ্বাস করব ; আলোক নতুন, কিন্তু আমার ঐ দীপ সনাতন ।” তার শয়নগৃহে বিষাক্ত বাতাস জমা হয়ে রয়েছে ; সেইটােতেই সে পড়ে থাকতে চায়, কেননা, সে যে হল তার সঞ্চিত বাতাস, সে নতুন বাতাস নয় । ঈশ্বরের আলো ঈশ্বরের বাতাস কেবলই যে নতুনকে আনে সেই নতুনকে সে বিশ্বাস করছে না। ঘরের কোণের অন্ধকারটা পুরাতন, তাকেই সে পূজা করে। এইজন্য ঈশ্বরকে ইতিহাসের বেড়া যুগে যুগে ভাঙতে হয় । তার আলোককে তঁর আকাশকে যা নিষেধ করে দাঁড়ায় তারই উপরে একদিন তঁর বাজ এসে পড়ে, সেইখানে একদিন তার ঝড় বয়। তবে মুক্তি । তৃপাকার সংস্কার যা জমা হয়ে উঠে সমস্ত চলাবার পথকে আটকে বসে আছে সেইখানে রক্তস্রোত বয়ে যায়। তবে মুক্তি। স্বার্থের সঞ্চয় যখন অভ্ৰভেদী হয়ে ওঠে তখন কামানের গোলা দিয়ে তাকে ভাঙতে হয় । তবে মুক্তি। তখন কান্নায় আকাশ ছেয়ে যায়, কিন্তু সেই কান্নার ধারা নইলে উত্তাপ দূর হবে কেমন করে । চিরদিন এমনি করে সত্যের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে মানুষ । মানুষের নিজের হাতের গড়া জিনিসের উপর মানুষের বড়ো মোহ ; সেইজন্য মানুষ নিজের হাতেই নিজে মাের খায় । মানুষ নিজের হাতে নিজেকে মারবার গদা তৈরি করে । সেইজন্য আজ সেই নিজের হাতে গড়া গদার আঘাতে রাজ্য-সাম্রাজ্যের সমস্ত সীমা চুৰ্ণ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের স্বাৰ্থ বুদ্ধি আজ বলছে, ‘ধর্মবুদ্ধির কোনো কথা আমি শুনতে চাই না, আমি গায়ের জোরে সব কেড়েকুড়ে নেব।” সংসারের পোষ্যপুত্র যারা তারা সংসারের ধর্ম গ্রহণ করে ; সে ধর্মযে সবল সে দুর্বলের উপর প্রভুত্ব করবে। কিন্তু, মানুষ যে সংসারের পুত্র নয়, সে যে অমৃতের পুত্র; সেইজন্য তাকে নিজের গদা দিয়ে স্বার্থের ধর্ম, যা তার পরধর্ম, তাকে ধূলিসাৎ করতে হবে। এ সংগ্রাম মানুষকে করতেই হবে । যা জমিয়েছে তাকে চিরকালই আঁকড়ে ধরে রাখবে এ কেমন মমতা । যেমন দেহের প্ৰতি আমাদের মমতা । আমরা কি হাজার চেষ্টা করলেও দেহকে রাখতে পারি। যতই কেঁদে মরি-না কেন, যতই বলি-না কেন যে তার সঙ্গে অনেক দিন ধরে আমার সম্বন্ধ- তাকে রাখতে পারব না, কারণ তাকে রক্ষা মানেই মৃত্যুকে ধরে রাখা । আমাদের-যে দেহকে ত্যাগ করে মৃত্যুকেই মারতে হয় । তেমনি বাপ-পিতামহ থেকে যা চলে আসছে, যা জমে রয়েছে, তাকে চিরকাল ধরে রাখবার ইচ্ছাও মৃত্যুকে ধরে রাখবার ইচ্ছামাত্র । দেহকে রাখতে পারলুম না, পুরাতনকেও রাখতে পারব না । ইতিহাসবিধাতা। তাই বললেন নতুন হতে হবে । কামানের গর্জনে আজ সেই বাণীই শুনতে পাচ্ছিনতুন হতে হবে। জাতীয়তার আদর্শকে নিয়ে যুরোপ এতকাল ধরে তার প্রতাপকে অভ্ৰভেদী করে তুলেছে। ছোটো জাহাজ ছিল, তার পর বড়ো জাহাজ, তার পর বড়ো জাহাজ থেকে আরো বড়ো জাহাজ । কামান ছোটো ছিল, তা থেকে আরো বড়ো কামান গড়ে তুলে যুরোপ তার মারণ-অস্ত্ৰ সব এতকাল বসে শানিয়েছে । জলে স্থলে এই সব ব্যাপার করে তুলে তার তৃপ্তি হল না ; আকাশে পর্যন্ত মারবার যন্ত্র তাকে তৈরি করতে হল । নিজের প্রতাপকে এমনি করে অভ্ৰভেদী করে সে দুর্বলকে টিপে তার রক্ত পান করবে, এমন কথা কি সে বলতে পারে । মানুষ মানুষকে খেয়ে বঁাচবে, এই হবে ? ইতিহাসবিধাতা তাই হতে দেবেন ? না । তিনি কামানের গর্জনের ধ্বনির ভিতর দিয়ে বলেছেন নতুন হতে হবে । যুরোপে নতুন হবার সেই ডাক উঠেছে। সেই আহবান আমাদের মধ্যে নেই ? আমরাই জরাজীর্ণ হয়ে থাকব ? ইতিহাসবিধাতা কি আমাদেরই আশা ত্যাগ করেছেন । দুৰ্গতির পর দুৰ্গতি, দুঃখের পর দুঃখ দিয়ে তিনি আমাদের দেশকে বলছেন, "না, হয় নি, তোমাদেরও হয় নি, নতুনকে লাভ অমৃতকে লাভ হয় নি । তুমি যে আবৰ্জনাস্তৃপ জমিয়েছ তা তোমাকে আশ্রয় দিতে পারে নি। আমি অনন্ত প্ৰাণ, আমায় বিশ্বাস করো। বীর পুত্ৰ, দুঃসাহসিক পুত্ৰ সব বেরিয়ে br8 S.