পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዪጓóbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আসন পাতা হয়ে থাকে, এ সভার প্রান্তে যদি ভক্তের হৃদয় জেগে থাকে, তবেই সার্থক হয়েছে এই প্ৰদীপ জ্বালা, সার্থক হয়েছে। এই সংগীতের ধ্বনি, এই সমস্ত উৎসবের আয়োজন । এই উৎসব যাত্রীর উৎসব । আমরা বিশ্বযাত্রী ; পথের ধারের কোনো পান্থশালাতে আমরা বদ্ধ নাই । কোনো বাধা মতামতের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে দাঁড়িয়ে থেকে উৎসব হয় না- চলার পথে উৎসব, চলতে চলতে উৎসব। এ উৎসব কবে আরম্ভ হয়েছে। যেদিন এই পৃথিবীতে মায়ের কোলে জন্মগ্রহণ করেছি। সেই দিন থেকে এই আনন্দ-উৎসবের আমন্ত্রণ পীেচেছে ; সেই আহবানে সেই দিন থেকে পথে বেরিয়েছি । সেই যাত্রীর সঙ্গে সেই দিন থেকে তুমি যে সহযাত্রী, তাই তো যাত্রীর উৎসব জমেছে। মনে হয়েছিল যে পথে চলেছি সে সংসারের পথ- তার মাঝে সংসার, তার শেষে সংসার ; তার লক্ষ্য ধনমান, তার অবসান মৃত্যুতে । কিন্তু না, পথ তো কোথাও ঠেকে না, সমস্তকেই যে ছাড়িয়ে যায়। তুমি সহযাত্রী তার দক্ষিণ হাত ধরে কত সংকটের মধ্য দিয়ে, সংশয়ের মধ্য দিয়ে, সংগ্রামের ভিতর দিয়ে, তাকে পাশে নিয়ে চলেইছ ; কোনাে-কিছুতে এসে থামতে দাও নি। সে বিদ্যুপ করেছে, বিরুদ্ধতা করেছে, কিন্তু তুমি তার দক্ষিণ হাত ছাড় নি। তুমি সঙ্গে সঙ্গে চলেছ ; তুমি তাকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছ। সেই অনন্ত মনুষ্যত্বের বিরাট রাজপথে, সেখানে সমস্ত যাত্রীর দল চিরজীবনের তীর্থে চলেছে। ইতিহাসের সেই প্রশস্ত রাজপথে কী আনন্দকোলাহল, কী জয়ধ্বনি ! সেই তো উৎসবের আনন্দধ্বনি ! তুমি বদ্ধ করা নি, তুমি বদ্ধ হতে দেবে না, তুমি কোনো মতের মধ্যে প্রথার মধ্যে মানুষকে নজরবন্দী করে রাখবে না । তুমি বলেছ, “মাভৈঃ, যাত্রীর দল বেরিয়ে পড়ে ।” কেন ভয় নেই। কিসে নিৰ্ভয় । তুমি যে সঙ্গে সঙ্গে চলছ। তাই তো যে চলছে সে কেবলই তোমাকে পাচ্ছে । যে চলছে না। সে আপনাকেই পাচ্ছে, আপনার সম্প্রদায়কেই পাচ্ছে । । অনন্তকাল যিনি আকাশে পথ দেখিয়ে চলেছেন তিনি কবে চলবে বলে কারও জন্যে অপেক্ষা করবেন। না । যে বসে রয়েছে সে কি দেখতে পাচ্ছে না। তার বন্ধন। সে কি জানে না যে এই বন্ধন না খুলে ফেললে সে মুক্ত হবে না, সে সত্যকে পাবে না। সত্যকে বেঁধেছি, সত্যকে সম্প্রদায়ের কারাগারে বন্দী করেছি। এমন কথা কে বলে ! অনন্ত সত্যকে বন্দী করবে ? তুমি যত বড়ো মুগ্ধ হও-না কেন, তোমার মোহ-অন্ধকারের জাল বুনিয়ে বুনিয়ে অনন্ত সত্যকে ঘিরে ফেলবে এত বড়ো স্পর্ধার কথা কোন সম্প্রদায় উচ্চারণ করতে ps সত্যকে হাজার হাজার বৎসর ধরে বেঁধে আচল করে রেখে দিয়েছি, এই বলে আমরা গৌরব করে থাকি । সত্যকে পথ চলতে বাধা দিয়েছি- তাকে বলেছি ; “তোমার আসন এইটুকুর মধ্যে, এর বাহিরে নয়, তুমি গণ্ডি ডিঙিয়ে না, তুমি সমুদ্র পেরিয়ো না।” সত্যের অভিভাবক। আমি, আমি তাকে মিথ্যার বেড়ার মধ্যে খাড়া দাড় করিয়ে রাখব।-- মুগ্ধদের জন্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে যে পরিমাণে মেশানো দরকার সেই মেশানোর ভার আমার উপর- এমন সব স্পর্ধাবাক্য আমরা এতদিন বলে এসেছি । ইতিহাসবিধাতা সেই স্পর্ধা চুৰ্ণ করবেন না ? মানুষ অন্ধ জড়প্রথার কারাপ্রাচীর যেখানে অভ্ৰভেদী করে তুলবে এবং সত্যের জ্যোতিকে প্ৰতিহত করবে। সেখানে তার বাজ পড়বে না ? তিনি এ কেমন করে সহ্য করবেন । তিনি কি বলতে পারেন যে তিনি বন্দী । তিনি এ কথা বললে সংসারকে কে বাচাবে । তিনি বলেছেন, ‘সত্য মুক্ত, আমি মুক্ত, সত্যের পথিক তোমরা মুক্ত।’ এই উদবোধনের মন্ত্র মুক্তির মন্ত্র এখনই নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে ; অনন্তকাল জাগ্রত থেকে তারা সেই জ্যোতির্ময় মন্ত্র উচ্চারণ করছে। জপ করছে এই মন্ত্র সেই চিরজাগ্ৰত তপস্বীরা ; জাগ্রত হও, জাগ্রত হও ; প্রাচীর দিয়ে বঁধিয়ে সত্যকে বন্দী করে রাখবার চেষ্টা । কোরো না । সত্য তা হলে নিদারুণ হয়ে উঠবে ; যে লোহার শৃঙ্খল তার হাতকে বাধবে সেই শৃঙ্খল দিয়ে তোমার মন্তকে সে করাঘাত করবে । রুদ্ধ সত্যের সেই করাঘাত কি ভারতবর্ষের ললাটে এসে পড়ে নি। সত্যকে ফাসি পরাতে চেয়েছে যে দেশ সে দেশ কি সত্যের আঘাতে মুছিত হয় নি। অপমানে মাথা হেঁট হয় নি ? সইবে না বন্ধন ; বড়ো দুঃখে ভাঙবে, বড়ো অপমানে ভাঙবে । সেই উদবোধনের প্রলয়মন্ত্র পৃথিবীতে জেগেছে, সেই ভাঙবার মন্ত্র জেগেছে । বসে থাকবার নয়, কোণের মধ্যে তামসিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকবার নয়- চলাবার, ভাঙবার ডাক আজ এসেছে। আজকের সেই উৎসব, সেই সর্ত্যের মধ্যে উদবোধিত হবার উৎসব।