পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Ved আমরা সেই মুক্তির মন্ত্র পেয়েছি। কালের স্রোতে ডুবল না। সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্মা, অন্তহীন সত্য, অন্তহীন ব্ৰহ্মের মন্ত্র । কবে ভারতবর্ষের তপোবনে কোন সুদূর প্রাচীন কালে এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল— অন্ত নেই তার অন্ত নেই। অন্তহীন যাত্রাপথে সত্যকে পেতে হবে, জ্ঞানকে পেতে হবে । সমস্ত সম্প্রদায়ের বাইরে দাড়িয়ে মুক্ত নীলাকাশের তলে একদিন আমাদের পিতামহ এই মুক্তির মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন । সেই-যে মুক্তির আনন্দ ঘোষণার উৎসব সে কি এই ঘরের কোণে বসে আমরা কজনে সম্পন্ন করব, এই কলকাতা শহরের এক প্রান্তে । ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এই মুক্তির উৎসবের আনন্দধবনি বেজে উঠবে না ? এই মুক্তির বাণীকে আমাদের পিতামহ কোথা থেকে পেয়েছিলেন । এই অনন্ত আকাশের জ্যোতির ভিতর থেকে একে তিনি পেয়েছেন, বিশ্বের মর্মকুহর থেকে এই মুক্তিমন্ত্রের ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন । এই-যে মুক্তির মন্ত্র আগুনের ভাষায় আকাশে গীত হচ্ছে, সেই আগুনকে তারা এই কাটি সহজ বাণীর মধ্যে প্রস্ফুটিত করেছেন। সেই বাণী আমরা ভুলব ? আর বলব সত্য পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে ইতিহাসের জীৰ্ণ দেয়ালে ভাঙা-ঘড়ির কাটার মতো চিরদিনের জন্য থেমে গেছে ? গৌরব করে বলব। “আমাদেরই দেশে সচল সত্য অচল পাথর হয়ে গেছে- বুকের উপরে সেই জগদ্দল পাথরের ভার আমরা বইছি’ ? না, কখনোই না । উদবোধনের মন্ত্র আজ জগৎ জুড়ে বাজছে ; যাত্রী, বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো। ভেঙে ফেলো তোমার নিজের হাতের রচিত কারাগার। সেই যাত্রীদের সঙ্গে চলে যারা চন্দ্ৰ-সূৰ্য তারার সঙ্গে এক তালে পা ফেলে ফেলে চলছে। ১১ মাঘ ১৩২১, সন্ধ্যার উদবোধন । ফায়ুন ১৩২১ মাধুর্যের পরিচয় আমাদের মন্ত্রে আছে ; পিতা নোহসি পিতা নো বোধি । তুমি আমাদের পিতা, তুমি পিতা আমাদের এই বোধ দাও । এই পিতার বোধ আমাদের অন্তঃকরণে সজাগ নেই বলে আমাদের যেমনই ক্ষতি হোক, পিতার সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধের দিক দিয়ে তার কাজ সমােনই চলেছে। আমাদের বোধের অসম্পূর্ণতাতে র্তার কোনো ব্যাঘাত হয় নি। তিনি তঁর সমস্ত সন্তানের মধ্যে চৈতন্য ও প্ৰাণ প্রেরণ করেছেন, তঁর পিতৃত্ব মানবসমাজে কাজ করেই চলেছে । কিন্তু, এক জায়গায় তিনি সুপ্ত হয়ে আছেন ; তিনি যেখানে আমাদের প্ৰিয়তম সেখানে তিনি জাগেন নি । যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার প্ৰেম উদবোধিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মার গভীর অন্ধকার নির্জনতার মধ্যে সেই প্রিয়তম সুপ্ত হয়ে আছেন। সংসারের সকল রসের ভিতরে যে র্তার রস, সকল মাধুর্য সকল গ্ৰীতির মূলে যে র্তার শ্ৰীতি- এ কথা আমি জানলুম না। আমার প্ৰেম জাগল না । অথচ তিনি যে সত্যই প্ৰিয়তম এ কথা সত্য । এ বললে স্বতো বিরুদ্ধতা দোষ ঘটে ? কারণ তিনি যদি প্রিয়তম তবে তাকে ভালোবাসি না কেন । কিন্তু, তা বললে কী হবে, তিনি আমার প্রিয়তম না হলে এত বেদনা আমি পাব কেন । কত মানুষের ভিতরে জীবনের তৃপ্তির সন্ধান করা গেল, ধনমানের পিছনে পিছনে মরীচিকার সন্ধানে ফেরা গেল ; মন ভরল না, সে কেঁদে বলল, “জীবন ব্যর্থ হল- এমন একটি এককে পেলুম না। যার কাছে সমস্ত শ্ৰীতিকে নিঃশেষে নিবেদন করে দিতে পারি, দ্বিধা-সংশয়ের হাত থেকে একেবারে নিষ্কৃতি পেতে পারি।” ক্ষণে ক্ষণে এ মানুষকে ও মানুষকে আশ্রয় করলুম ; কিন্তু, জীবনের সেই সব প্রেমের বিচ্ছিন্ন মুহুর্তগুলিকে ভরে তুলবে কেমন করে। কোন মাধুর্যের প্লাবনে ছেদগুলো সব ভরে যাবে। এমন একের কাছে আপনাকে নিবেদন করি নি বলেই এত বেদনা পাচ্ছি। তিনি যে আমার প্ৰিয়তম এই কথাটা জানলুম না বলেই এত দুঃখ আমার । তিনি সত্যই প্ৰিয়তম বলেই যা পাচ্ছি। তারই মধ্যে দুঃখ রয়ে যাচ্ছে, তাতে প্ৰেম চরিতার্থ হচ্ছে কই । আমরা সব সন্ধানের মধ্যে এককেই খুঁজছি, এমন কিছুকে খুঁজছি যা সব বিচ্ছিন্নতাকে জোড়া দেবে । জ্ঞান কি জোড়া দিতে পারে। জ্ঞান একটা বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুকে একবার মিলিয়ে দেখে, একবার বিশ্লেষ করে দেখে ।