পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VeVeo রবীন্দ্র-রচনাবলী বিরোধটাকে মেটাতে পারে প্রেম, বৈচিত্র্যের সামঞ্জস্য ঘটাতে পারে প্রেম। বৈচিত্র্যের এই মরুভূমির মধ্যে আমাদের তৃষ্ণা কেবলই বেড়ে উঠতে থাকে ; জ্ঞান সেই বৈচিত্র্যের অন্তহীন সূত্ৰকে টেনে নিয়ে ঘুরিয়ে মারবে- সে তৃষ্ণা মেটাবে কেমন করে । সেই প্ৰেম না জাগা পর্যন্ত কী ঘোরাটাই ঘুরতে হয় ! একবার ভাবি ধনী হই, ধনে বিচ্ছিন্নতা ভরে দেবে, সোনায় রুপোয় সব পূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু, সোনায় রুপোয় সে ফাক কি ভরতে পারে । খ্যাতি-প্রতিপত্তি, মানুষের উপরে প্রভাববিস্তার, কিছু দিয়েই সে ফাক ভরে না । প্রেমে সব ফাক ভরে যায়, সব বৈচিত্র্য মিলে যায় । মানুষ যে তার সমস্ত চেষ্টার ভিতর দিয়ে কেবলই সেই প্রেমকে খুঁজে বেড়াচ্ছে- সত্যই যে তার প্রিয়তম । সত্য যদি প্রিয়তম না হবেন তবে তার বিরহে মানুষ কি এমন করে লুটিয়ে পড়ত। যাকে সত্য বলে আঁকড়ে ধরতে যায় সে যখন শূন্য হয়ে যায়। তখন মানুষের সেই বেদনার মতো বেদনা আর কী আছে। মানুষ তাই একান্তমনে এই কামনাই করছে ; আমার সকল প্রেমের মধ্যে সেই একের প্ৰেমরস বর্কিত হােক, আমার সব রন্ধ পূর্ণ হয়ে যাক । মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে পাত্রের মতো করে তার প্রেমের অমৃতে পূর্ণ করে মানুষ পান করতে চায় । অন্তরাত্মার এই কামনা, এই সাধনা, এই ক্ৰন্দন । কিন্তু অহমের কোলাহলে এ কান্না তার নিজের কানেই পৌঁচাচ্ছে না । প্ৰতিবারেই সে মনে করছে, “বডড ঠিকেছি, আর ঠিক নয়, এবার যা চাচ্ছি। তাতেই আমার সব অভাব ভরে যাবে।” হায় রে, সে অভাব কি আর-কিছুতে ভরে !! এমন মোহান্ধ কেউ নেই। যার আত্মা পরম বিরহে এই বলে কঁদছে না “প্রিয়তম জাগলেন না । ফুলের মালা টাঙানো হয়েছে, বাতি জ্বালানো হয়েছে, সব আয়োজন পূর্ণ, শুধু তাকে ডাকলুম না— তাকে জাগালুম না। যেখানে তিনি পিতামাতা সেখানে তিনি অন্নপান দিচ্ছেন, প্ৰাণকে বাচিয়ে রাখছেন । মায়ের ভাণ্ডার তো খোলা রয়েছে ; ধরণীর ভোজে মা পরিবেশন করছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে সব দিচ্ছেন । সেখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু, যখন জগতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি এত সৌন্দর্য কেন, এত ফুল ফুটল কেন, আকাশে এত তারার প্রদীপ জ্বলল কেন, জীবনে মাঝে মাঝে বসন্তের দক্ষিনে হাওয়া যৌবনের মর্মরধ্বনি জাগিয়ে তোলে কেন, তখন বুঝি যে প্রিয়তম জাগলেন না- তারই জাগার অপেক্ষায় যে এত আয়োজন । তাই আমি আমার অন্তরাত্মাকে যা-কিছু এনে দিচ্ছি। সে সব পরিহার করছে। সে বলছে, “এ নয়, এ নয়, এ নয়- আমি আমার প্ৰিয়তমকে চাই ।” আমি তাকে না পেয়েই তো পাপে লুটােচ্ছি, আমি ক্ষুধাতৃষ্ণার এই দাহ সহ্য করছি, আমি চারি দিকে আমার অশান্ত প্ৰবৃত্তি নিয়ে দস্যবৃত্তি করে বেড়াচ্ছি। র্যাকে পেলে সব মিলবে তাকে পাওয়া হয় নি বলেই এত আঘাত দিচ্ছি। যদি তাকে পেতুম বলতুম, “আমার হয়ে গেছে । আমার দিনের পর দিন, জীবনের পর জীবন ভরে গেল।” সমস্ত সৌন্দর্যের মাঝখানে যেদিন সেই সুন্দরকে দেখলুম, সমস্ত মাধুর্যের ভিতরে যেদিন সেই মধুরকে পেলুম, সেদিন আমার মাধুর্যের পরিচয় দেব কিসে। মাধুর্যে বিগলিত হয়ে কি পরিচয় দেব। না । মাধুর্যের পরিচয় মাধুর্যে নয়, মাধুর্যের পরিচয় বীর্যে। সেদিন মৃত্যুকে স্বীকার করে পরিচয় দেব। বলব, “প্রিয়তম হে, মরব তোমার জন্য । আমার আর শোক নেই, ক্ষুদ্রতা নেই, ক্ষতি নেই। প্ৰাণের মায়া আর আমার রইল না— বলো-না তুমি, প্রাণকে তোমার কোন কাজে দিতে হবে ।’ তোমাকে পেলে ধুলোয় লুটিয়ে কেঁদে বেড়ােব তা নয়, কেবল মধুর রসের গান করব তা নয় গো । যেদিন বলতে পারব “যিনি মধুর পরম মধুর, যিনি সুন্দর পরম সুন্দর, তিনি আমার প্রিয়তম, তিনি আমায় স্পর্শ করেছেন সেদিন আনন্দে দুৰ্গম পথে সমস্ত কণ্টককে পায়ে দলে চলে যাব । সেদিন জানিব যে কর্মে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, ত্যাগে কোথাও কৃপণতা থাকবে না। কোনো বাধাকে বাধা বলে মানব না। মৃত্যু সেদিন সামনে দাঁড়ালে তাকে বিদ্রুপ করে চলে যাব । সেদিন বুঝব তার সঙ্গে আমার মিলন হয়েছে। মানুষকে সেই মিলন পেতেই হবে। দেখতে হবে দুঃখকে মৃত্যুকে সে ভয় করে না। স্পর্ধা করে বীরত্ব করলে সে বীরত্ব টেকে না- জগৎ ভরা আনন্দ যেদিন অস্তরে সুধাম্রোতে বয়ে যাবে সেদিন মানুষের সমস্ত মনুষ্যত্ব সরল হবে, তার কর্ম সহজ হবে, তার ত্যাগ সহজ হবে । সেদিন মানুষ বীর। সেদিন ইচ্ছা করে সে বিপদকে বরণ করবে । প্রিয়তম যে জাগিবেন। সে খবর পাব কেমন করে । গান যে বেজে উঠবে। কী গান বাজবে । সে তো সহজ গান নয়, সে যে রুদ্রবীণার গান। সেই গান শুনে মানুষ বলে উঠবে, “সৌন্দর্যে অভিভূত হব বলে এ