পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \ტNტ\9 একটি বিরাট প্ৰাণ না থাকত। তবে এই জগৎজোড়া লুকোচুরি খেলায় সে তো একটি ঘাসের মধ্যেও ধরা ୭୯୭୯୭ ୩ | এই ঘাসটুকুর মধ্যে আমরা কী দেখছি। যেমন গানের মধ্যে, আমরা তান দেখে থাকি । বৃহৎ অঙ্গের ধ্রুপদ গান চলছে ; চোতালের বিলম্বিত লয়ে তার ধীর মন্দ গতি ; যে ওস্তাদের মনে সমগ্ৰ গানের রূপটি বিরাজ করছে মাঝে মাঝে সে লীলাচ্ছলে এক-একটি ছোটো ছোটো তানে সেই সমগ্রের রূপটিকে ক্ষণেকের মধ্যে দেখিয়ে দেয়। মাটির তলে জলের ধারা রহস্যে ঢাকা আছে, ছিদ্রটি পেলে সে উৎস হয়ে ছুটে বেরিয়ে আপনাকে অল্পের মধ্যে দেখিয়ে দেয় । তেমনি উদ্ভিদে পশুপাখিতে প্ৰাণের যে চঞ্চল লীলা ফোয়ারার মতো ছুটে ছুটে বেরোয় সে হচ্ছে অল্পপরিসরে নিখিল সত্যে প্ৰাণময় রূপের পরিচয় । এই প্ৰাণের তত্ত্বটি কী তা যদি কেউ আমাদের জিজ্ঞাসা করে তবে কোনো সংজ্ঞার দ্বারা তাকে আটেঘাটে বেঁধে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে পারি। এমন সাধ্য আমাদের নেই। পৃথিবীতে তাকেই বোঝানো সব চেয়ে শক্ত যাকে আমরা সব চেয়ে সহজে বুঝেছি। প্ৰাণকে বুঝতে আমাদের বুদ্ধির দরকার হয় নি, সেইজন্যে তাকে বোঝাতে গেলে বিপদে পড়তে হয় । আমাদের প্রাণের মধ্যে আমরা দুটি বিরোধকে অনায়াসে মিলিয়ে দেখতে পাই । এক দিকে দেখি আমাদের প্রাণ নিয়ত চঞ্চল ; আর-এক দিকে দেখি সমস্ত চাঞ্চল্যকে ছাপিয়ে, অতীতকে পেরিয়ে, বর্তমানকে অতিক্রম করে প্রাণ বিন্তীর্ণ হয়ে বর্তে আছে। বস্তুত সেই বর্তে থাকার দিকেই দৃষ্টি রেখে আমরা বলি। আমরা বেঁচে আছি । এই একই কালে বর্তে না থাকা, এবং বর্তে থাকা, এই নিত্য চাঞ্চল্য এবং নিত্য স্থিতির মধ্যে ন্যায়শাস্ত্রের যদি কোনো বিরোধ থাকে। তবে তা ন্যায়শাস্ত্ৰেই আছে- আমাদের প্রাণের মধ্যে নেই । যখন আমরা বেঁচে থাকতে চাই তখন আমরা এইটেই তো চাই । আমরা আমাদের স্থিতিকে চাঞ্চল্যের মধ্যে মুক্তি দান করে এগিয়ে চলতে চাই। যদি আমাদের কেউ অহল্যার মতো পাথর করে স্থির করে রাখে। তবে বুঝি যে সেটা আমাদের অভিশাপ। আবার যদি আমাদের প্রাণের মুহুর্তগুলিকে কেউ চকমকি ঠোকা স্মৃলিঙ্গের মতো বর্ষণ করতে থাকে তা হলে সে প্রাণকে আমরা একখানা করে পাই নে বলে তাকে পাওয়াই श कीं । এমনি করে প্রাণময় সত্যের এমন একটি পরিচয় নিজের মধ্যে অনায়াসে পেয়েছি যা অনির্বাচনীয় অথচ সুনিশ্চিত, যা আপনাকে আপনি কেবল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলেছে, যা অসীমকে সীমায় আকারবদ্ধ করতে করতে এবং সীমাকে অসীমের মধ্যে মুক্তি দিতে দিতে প্রবাহিত হচ্ছে । এর থেকেই নিখিল সত্যকে আমরা নিখিলের প্রাণরূপে জানতে পারছি। বুঝতে পারছি এই সত্য সকলের মধ্যে থেকেই সকলকে অতিক্রম করে আছে বলে বিশ্বসংসার কেবলই চলার দ্বারাই সত্য হয়ে উঠছে । এইজন্য জগতে স্থিরত্বই হচ্ছে বিনাশ, কেননা স্থিরত্বই হচ্ছে সীমায় ঠেকে যাওয়া । এইজন্যেই বলা হয়েছে। যদিদং কিঞ্চি জগৎ সর্বং প্ৰাণ এজাতি নিঃসৃতং । এই যা-কিছু সমস্তই প্ৰাণ হতে নিঃসৃত হয়ে প্ৰাণেই কম্পিত হচ্ছে। তবে কি সমস্তই প্ৰাণ । আর, অপ্ৰাণ কোথাও নেই ? অপ্ৰাণ আছে, কেননা দ্বন্দ্ব ছাড়া সৃষ্টি হয় না। কিন্তু সেই অপ্রাণের দ্বারা সৃষ্টির পরিচয় নয়। প্ৰাণটাই হল মুখ্য, অপ্ৰাণটা গৌণ । আমরা চলাবার সময় যখন পা ফেলি। তখন প্ৰত্যেক পা ফেলা একটা বাধায় ঠেকে । কিন্তু চলার পরিচয় সেই বাধায় ঠেকে যাওয়ার দ্বারা নয়, বাধা পেরিয়ে যাওয়ার দ্বারা । নিখিল সত্যেরও এক দিকে বাধা, আর-এক দিকে বাধামোচন । সেই বাধামোচনের দিকেই তার পরিচয় ; সেই দিকেই সে প্ৰাণস্বরূপ ; সেই দিকেই সে সমস্তকে মেলাচ্ছে এবং চালাচ্ছে । যেদিন এই কথাটি আমরা ঠিকমত উপলব্ধি করতে পেরেছি। সেদিন আমাদের ভয়ের দিন নয়, ভিক্ষার দিন নয় ; সেদিন কোনো উদ্ধৃঙ্খল দেবতাকে অদ্ভুত উপায়ে বশ করবার দিন নয়। সেদিন বিশ্বের সত্যকে আমারও সত্য বলে আনন্দিত হবার দিন । সেদিন পূজারও দিন বটে। কিন্তু, সত্যের পূজা তো কথার পূজা নয়। কথায় ভুলিয়ে সত্যের কাছে তো বর পাবার জো নেই। সত্য প্রাণময়, তাই প্ৰাণের মধ্যেই সত্যের পূজা । আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখেছি মানুষ , সত্যের বর পাচ্ছে, তার দৈন্য দূর হচ্ছে, তার তেজ বেড়ে উঠছে। কোথায় দেখেছি। যেখানে মানুষের চিত্ত