পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ۹و হৃদয়কে মার্জনা করতে হবে। আজ সেই তপস্যার আসনে পূজার আসনে উপবিষ্ট হও । যে পিতা সমস্ত মানবসন্তানের দুঃখ গ্ৰহণ করছেন, যার বেদনার অন্ত নেই, প্রেমের অন্ত নেই, যার প্রেমের বেদনা উদবেল হয়ে উঠেছে, তার সম্মুখে উপবিষ্ট হয়ে সেই তার প্রেমের বেদনাকে আমরা সকলে মিলে গ্ৰহণ করি । ৯ ভাদ্র SV)SS আশ্বিন-কার্তিক ১৩২১ সৃষ্টির ক্রিয়া অবকাশের পর আবার আমরা শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছি । আর-একবার আমাদের চিন্তা করবার সময় হয়েছে। এখানকার সত্য আহবানকে অন্তরের মধ্যে সুস্পষ্ট করে উপলব্ধি করবার জন্য এবং মনের মধ্যে যেখানে গ্ৰন্থি রয়েছে, দীনতা রয়েছে, তাকে মোচন করবার জন্য আবার আমাদের ভালো করে প্রস্তুত হতে হবে । এই শান্তিনিকেতনে যেখানে আমরা সকলে আশ্রয় লাভ করেছি এবং সম্মিলিত হয়েছি, এখানে এই সম্মিলনের ব্যাপারকে কোনো একটা আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করতে পারি। নে । বিশ্বের মধ্যে আমাদের জীবনের অন্যান্য যে-সকল সম্ভাবনা ছিল তাদের এড়িয়ে এই এখানে যে আমরা আশ্রয় পেয়েছি। এর মধ্যে একটা গভীর অভিপ্ৰায় রয়েছে। এখানে একটি সৃষ্টি হচ্ছে ; এখানে যারা এসেছে তারা কিছু দিচ্ছে, কিছু নিয়ে যাচ্ছে, এমনি করে ক্রমশ এখানে একটি জীবনের সঞ্চার হচ্ছে । এর মধ্যে নানা ভাঙাগড়ার কাণ্ড চলেছে ; কেউ বা এখানে স্থায়ী, কেউ অস্থায়ী। সুতরাং এই আশ্রমকে বাহির থেকে দেখলে মনে হওয়া কিছু আশ্চর্য নয় যে, এ ভাঙাগড়া বুঝি দৈবক্রমে ঘটছে। একটা ঘর তৈরি হবার সময় কত চুন সুরকি মাল মসলার অপব্যয় হয়, চার দিকে এলোমেলো হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে সেগুলো পড়ে থাকে । কিন্তু, সমস্ত ঘরটি যখন তৈরি হয়ে ওঠে তখন আদ্যোপান্ত হিসাব পাওয়া যায়। তখন কী অপব্যয় হয়েছিল তাকে কেউ গণনার মধ্যেই আনে না । তেমনি এই আশ্রমের প্রত্যেক মানুষের জীবনের ইতিহাসের হিসাব নিলে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে কেউ বা কিছু পাচ্ছে, কেউ বা কিছুই পায় নি। সে হিসাবে এখানকার সমগ্ৰ সৃষ্টির চেহারা দেখা যায় না । এই-যে এখানে চারি দিক থেকে প্ৰাণের প্রবাহ আসছে, এ ব্যাপারটাকে আমাদের খুব সত্য করে, খুব বড়ো করে অন্তরের মধ্যে দেখবার শক্তি লাভ করতে হবে। এ একটা বিশ্বের ব্যাপার। কত দিক থেকে প্ৰাণের ধারা এখানে আসছে এবং কত দিকে দিগন্তরে এখান থেকে পুনরায় বয়ে চলবে- একে আকস্মিক ঘটনা মনে করবার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের কোনো ব্যাপারকেই যে আমরা দেখতে পাই নে তার কারণ, আমরা সমস্ত মন দিয়ে দেখি নে । চোখ দিয়ে দেখতে পাই নে, কারণ এ তো চোখ দিয়ে দেখবার জিনিস নয় । একে যে চরিত্র দিয়ে দেখতে হয় । স্বভাব দিয়ে দেখতে হয় । স্বভাবের ভিতর দিয়ে দেখতে হয় বলেই স্বভাবকে বিশুদ্ধ করা দরকার হয় । আমরা এই আশ্রমে যতই উপদেশ দিই এবং যতই উপদেশ পাই-না কেন, এই আশ্রমের ভিতরে যে অমৃত-উৎসটি উঠছে তাকে দেখবার, তার কাছে যাবার শক্তি যে আমাদের সকলের রয়েছে তা নয়। সেই দেখতে পাই না বলেই উপদেশে কিছু হয় না, কথারচনা ব্যৰ্থ হয় । সেই আনন্দস্বরাপকে দেখলেই আনন্দ যে ভরে উঠবে। সেই আনন্দে যে সমস্ত ত্যাগ সহজ হয়ে যাবে, বিরোধ দূর হবে, সব নির্মল হবে, সকল বাধা কেটে যাবে। আনন্দের লক্ষণ দেখলেই চেনা যায়। যখন দেখি যে আমাদের ভিতরে দুশ্চিন্তা ও দুশ্চেষ্টা থামছে না, অন্যায় ক্ষুদ্রতা মিথ্যা কত কী আমাদের ঘিরে রয়েছে, তখন বুঝতে পারছি যে সেই আনন্দকে দেখবার শক্তি আমাদের হয় নি। তার লক্ষণ আমাদের মধ্যে ফুটছে না । আপনাকে এবং জগৎকে সত্য করে জানিবার ও দেখবার জন্যই মানুষ এই জগতে এসেছে। মানুষও যে-সমস্ত অনুষ্ঠান রচনা করেছে, তার বিদ্যালয়, তার রাজ্যসাম্রাজ্য, নীতিধর্ম, সমস্তেরই মূল কথা এই যে, মানুষ যে যথার্থ কী সেটা মানুষকে প্রকাশ করতে হচ্ছে। মানুষের অনুষ্ঠানে মানুষই বিরাট রূপ ধরে প্রকাশ