পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vetra রবীন্দ্র-রচনাবলী অবসান নেই। অজস্র ধারায় সেই জীবন, সেই আনন্দ, সেই প্ৰেম প্রবাহিত ; ভোগ করো, আনন্দে ভোগ করো । আকাশের নীলিমায়, কাননের শ্যামলিমায়, জ্ঞানে প্রেমে আনন্দে ভোগ করো, পরিপূর্ণরূপে ভোগ করো। মা গৃধঃ । মনের ভিতরে কোনো কলুষ কোনো লোভ না আসুক, পাপের লোভের সকল বন্ধন মুক্ত হােক । এই তার দীক্ষার মন্ত্র । এই মন্ত্র আশ্রমকে সৃষ্টি করেছে, এই মন্ত্র এই আশ্রমকে রক্ষা করেছে। এই আশ্রমের আকাশে, পুণা সমীরণে, নির্মল আলোকে, উদার প্রান্তরে, এই আমাদের সম্মিলিত জীবনের মধ্যে এই মন্ত্রকে দেখবার, শ্রবণ করবার, গ্ৰহণ করবার জন্য অদ্য এই উৎসব । চিত্ত জাগ্ৰত হােক, আশ্রমদেবতা প্ৰত্যক্ষ হােন, তিনি তার মন্দিরের দ্বার উদঘাটন করুন। এই ফুলের মতো সুকুমার তরুণজীবনগুলির উপর তীর স্নেহাশীর্বাদ পড়ুক ; বিকশিত হােক এরা পুণ্যে প্রেমে পবিত্রতায় ; স্মরণ করুক এই শুভদিন, গ্ৰহণ করুক এই মন্ত্র, এই চিরজীবনের পাথেয় । এদের সম্মুখে সমস্ত জীবনের পথ রয়েছে, অমৃত আশীর্বাদ এরা গ্ৰহণ করে যাত্রা করুক ; চিরজীবনের দীক্ষাকে লাভ করে এরা অগ্রসর হয়ে যাক। পথের সমস্ত বাধা বিপত্তি সংকটকে অতিক্রম করে যাবার জন্যে এই দীক্ষার মন্ত্র তাদের সহায় হােক । উদবোধিত হও, জীবনকে উদবোধিত করো ! প্ৰাতঃকাল ।। ৭ পৌষ ১৩২১ DARI S KOD SRS আরো আরো চাই, আরো চাই- এই গান উৎসবের গান । আমরা সেই ভাণ্ডারে এসেছি যেখানে আরো পাব । পৃথিবী ধনে ধান্যে পরিপূর্ণ, মানুষের ঘর স্নেহে প্রেমে পরিপূর্ণ। লক্ষ্মীর কোলে মানুষ জন্মেছে। সেখানে আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে। এক-একদিন তার বাইরে এসে “আরোর ভাণ্ডারের প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে মানুষের উৎসব। একদিন মানুষ পৃথিবীতে দেবতাকে বড়ো ভয় করেছিল। কে যে প্ৰসন্ন হলে জীবন সুখে স্বচ্ছন্দে কাটে, কে যে অপ্ৰসন্ন হলে দুর্যোগ উপস্থিত হয়, তা মানুষ কোনোমতেই সেদিন ভেবে পায় নি। যে শক্তির সঙ্গে আত্মার যোগ নেই তাকে প্ৰসন্ন রাখবার জন্য বলির পশু নিয়ে তখন ভয়াতুর মানুষ একত্র মিলেছে { তখনকার সেই ভয়ের পূজা তো উৎসব নয়। ডাকাতের হাতে পড়লে যেমন ভীরু বলে ওঠে "আমার যা আছে সব দিচ্ছি। কিন্তু আমায় প্ৰাণে মেরো না, তেমনি পৃথিবীর মধ্যে অদৃশ্য শক্তিকে খুশি রাখবার জনা সেদিন মানুষ বলেছিল ; আমি তোমাকে সব দেব, তুমি আমায় সংকটে ফেলো না ; কিন্তু, সে তো আনন্দের দান নয় । আনন্দের দেবতাকে উপলব্ধি করলে আর ভয় নেই । কারণ, এই আনন্দের দেবতাই যে “আরো’, এই তো সকলকে ছাড়িয়ে যায়। যা-কিছু পেয়েছি, বুঝেছি, তার চেয়ে তিনি আরো ; যা পাই নি, হারিয়েছি, তার চেয়েও তিনি আরো । তিনি ধনের চেয়ে আরো, মানের চেয়ে আরো, আরামের চেয়ে আরো । তাই তো সেই আরো'র পূজার, আরো’র উৎসবে মানুষ আনন্দে বলেছে : আমার ধন নাও, প্ৰাণ নাও, সম্মান নাও । অন্তরে এবং বাহিরে মানুষের এই যে আরো’কে জানা এ বড়ো আরামের জানা নয় । যেদিন মানুষ জেনেছে যে সে পশু নয়, তার দেবতা পাশবি নয়, সে বড়ো, তার দেবতা বড়ো, সেদিন সে যে পরম দুঃখকে স্বীকার করে নিয়েছে। সেদিন মানুষ যে বিজয়ী, মানুষ যে বীর, তাই সেই বিজয়লাভের জয়োৎসব সেদিন হবে না ? পাখি। যেমন অন্ধকারের প্রান্তে জ্যোতির স্পর্শমাত্রে অকারণ আনন্দে গেয়ে ওঠে, তেমনি যেদিন পরম জ্যোতি তাকে স্পর্শ করেন সেদিন মানুষও গেয়ে ওঠে। সেদিন সে বলে ; আমি অমৃতের পুত্র। সে বলে ; বেদাহমেতং, আমি পেয়েছি। সেই পাওয়ার জোরে নিজের মধ্যে সেই অমৃতকে অনুভব করে ভয়কে সে আর ভয় করে না, মৃত্যুকে গ্ৰাহ্য করে না, বিপদের সামনে দাড়িয়ে সে বলে ; আমার পথ সামনে, আমি পিছু হাটব না, আমার পরাজয় নেই- রুদ্র, তোমার প্রসন্নতা অন্তহীন ।