পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WZ)o o রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন সময়ে ধীরে ধীরে কে তাহার পাশে আসিয়া বসিল। সস্নেহে তাহার ধূলিলুষ্ঠিত চুলগুলি কপোলের উপর হইতে তুলিয়া দিবার চেষ্টা করিল। মৃন্ময়ী সবলে মাথা নাড়িয়া তাহার হাত সরাইয়া দিল। অপূর্ব কানের কাছে মুখ নত করিয়া যুদ্ধস্বরে কহিল, “আমি লুকিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি। এস আমরা খিড়কির বাগানে পালিয়ে ধাই।” মৃন্ময়ী প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া সতেজে সরোদনে কহিল, “না।” অপূর্ব তাহার চিবুক ধরিয়া মুখ তুলিয়া দিবার চেষ্টা করিয়া কছিল, "একবার দেখো কে এসেছে।” রাখাল ভূপতিত মৃন্ময়ীর দিকে চাহিয়া হতবুদ্ধির ন্যায় দ্বারের কাছে দাড়াইয়া ছিল। মৃন্ময়ী মুখ না তুলিয়া অপূর্বর হাত ঠেলিয়া দিল। অপুর্ব কহিল, “রাখাল তোমার সঙ্গে খেলা করতে এসেছে, খেলতে যাবে?” সে বিরক্তি-উচ্ছসিত স্বরে কহিল, “না ।” রাখালও সুবিধা নয় বুঝিয়া কোনোমতে ঘর হইতে পালাইয়া ইপি ছাড়িয়া বাচিল । অপূর্ব চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। মৃন্ময়ী কাদিতে কাদিতে শ্রাস্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িল, তখন অপূর্ব পা টিপিয়া বাহির হইয়া দ্বারে শিকল দিয়া চলিয়া গেল। তাহার পরদিন মৃন্ময়ী বাপের কাছ হইতে এক পত্ৰ পাইল । তিনি র্তাহার প্রাণপ্রতিমা মৃন্ময়ীর বিবাহের সময় উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই বলিয়া বিলাপ করিয়া নবদম্পতীকে অস্তরের আশীৰ্বাদ পাঠাইয়াছেন । মৃন্ময়ী শাশুড়ীকে গিয়া কহিল, “আমি বাবার কাছে যাব।” শাশুড়ী অকস্মাং এই অসম্ভব প্রার্থনায় তাহাকে ভৎসনা করিয়া উঠিলেন । “কোথায় ওর বাপ থাকে তার ঠিকানা নেই, বলে বাবার কাছে যাব। অনাস্থষ্টি আবদার ।” সে উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল। আপনার ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া নিতান্ত হতাশ্বাস ব্যক্তি যেমন করিয়া দেবতার কাছে প্রার্থনা করে তেমনি করিয়া বলিতে লাগিল, “বাবা, আমাকে তুমি নিয়ে যাও । এখানে আমার কেউ নেই। এখানে থাকলে আমি বঁচব না।” : গভীর রাত্রে তাহার স্বামী নিদ্রিত হইলে ধীরে ধীরে দ্বার খুলিয়া মৃন্ময়ী গৃহের বাহির হইল। যদিও এক-একবার মেঘ করিয়া আসিতেছিল তথাপি জ্যোৎস্নারাত্রে পথ দেখিবার মতো আলোক যথেষ্ট ছিল । বাপের কাছে যাইতে হইলে কোন পথ অবলম্বন করিতে হইবে মুন্ময়ী তাহার কিছুই জানিত না । কেবল তাহার মনের বিশ্বাস ছিল, ষে-পথ দিয়া ডাকের পত্রবাহক ‘রানারগণ চলে সেই পথ দিয়া পৃথিবীর সমস্ত ঠিকানায় যাওয়া যায়। মৃন্ময়ী সেই ডাকের পথ ধরিয়া চলিতে লাগিল। চলিতে চলিতে শরীর প্রাস্ত হইয়া আসিল, রাত্রিও প্রায় শেষ হইল। বনের মধ্যে যখন উলখুল করিয়া অনিশ্চিত মুরে দুটো-একটা পাখি ডাকিবার উপক্রম করিতেছে অথচ নিঃসংশয়ে সময় নির্ণয় করিতে না পারিয়া ইতস্তত করিতেছে তখন মৃন্ময়ী পথের শেষে নদীর ধারে একটা