পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

రిqbr রবীন্দ্র-রচনাবলী জাতায় ফেলিয়া পেষ—ইহার জীবধর্মকে নষ্ট করিয়া ফেল। কিন্তু যিনি যাহাই বলুন ব্রাহ্মধর্ম কোনো একটি বিশেষ নির্দিষ্ট সুপ্রণালীবদ্ধ তত্ত্ববিদ্যা নহে। কারণ, আমরা ইহাকে ভক্তের জীবনউৎস হইতে উৎসারিত হইতে দেখিয়াছি। তাহ ডোবা নহে, বাধানো সরোবর নহে, তাহা কালের ক্ষেত্রে ধাবিত নদী - তাহার রূপ প্রবহমান রূপ তাহা বাধাহীন বেগে নব নব যুগকে আপন অমৃতধারা পান করাইয়া চলিবে,—নব নব হেগেল ও গ্রীন তাহার মধ্যে নব নব পাথরের ঘাট বাধাইয়া দিতে থাকিবে, - কিন্তু সে সকল ঘাটকেও তাহা বহুদূরে ছাড়াইয়া চলিবে—কোনো স্পর্ধিত তত্ত্বজ্ঞানীকে সে এমন কথা কদাচ বলিতে দিবে না যে ইহাই তাহার শেষ তত্ত্ব। কোনো দৰ্শনতত্ত্ব এই ধর্মকে একেবারে বাধিয়া ফেলিবার জন্য যদি ইহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ফাস লইয়া ছোটে তবে এ কথা তাহাকে মনে রাখিতে হইবে যে, যদি ইহাকে বন্দী করিতে হয় তবে তাহার আগে ইহাকে বধ করিতে হইবে । তাই যদি হইল তবে ব্রাহ্মধর্মের ভাবাত্মক লক্ষণটি কী ? তাহা একটা মোট কথা, তাহা অনন্তের ক্ষুধাবোধ, অনস্তের রসবোধ । এই অনস্তের জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করিয়া যিনি যেরূপ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করুন তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই, কারণ এরূপ ব্যাখ্যা চিরকালই চলিবে, এ রহস্তের অন্ত পাওয়া যাইবে না ; কিন্তু আসল কথা এই ষে রামমোহন রায় হইতে কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত সকলেরই জীবনে আমরা এই অনন্তের ক্ষুধাবোধের আনন্দ প্রত্যক্ষ করিয়াছি । দেশের প্রচলিত আচার ও ধর্মবিশ্বাস যে র্তাহাদের জ্ঞানকে আঘাত দিয়াছে তাহা নহে, তাহাদের প্রাণকে আঘাত দিয়াছে। কিন্তু ব্রাহ্মধর্মকে কয়েকজন মানুষের জীবনের মধ্য দিয়া দেখিতে গেলেও তাহাকে ছোটো করিয়া দেখা হইবে । বস্তুত ইহা মানব-ইতিহাসের সামগ্রী । মানুষ আপনার গভীরতম অভাব মোচনের জন্য নিয়ত যে গৃঢ় চেষ্টা করিতেছে ব্রাহ্মসমাজের স্বষ্টির মধ্যে আমরা তাহারই পরিচয় পাই । মানুষ যতবারই কৃত্রিম আচারপদ্ধতির দ্বারা অনস্তকে ছোটো করিয়া আপনার সুবিধার মতো করিয়া লইতে চেষ্টা করিয়াছে ততবারই সে সোনা ফেলিয়া আঁচলে গ্রন্থি বাধিয়াছে। আমি একবার অত্যন্ত অদ্ভূত এই একটা স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম যে, মা তাহার কোলের ছেলেটিকে সর্বত্র অতি সহজে বহন করিবার সুবিধা করিতে গিয়া তাহার মুগুটা কাটিয়া লইয়াছিল। ইহা স্বপ্ন বটে কিন্তু মানুষ এমন কাজ করিয়া থাকে। আইডিয়াকে সহজসাধ্য করিবার জন্য সে তাহার মাথা কাটিয়া তাহাকে দিব্য সংক্ষিপ্ত করিয়া লয় ইহাতে মুগুটাকে করতলন্তস্ত আমলকবং আয়ত্ত করা যায় বটে কিন্তু প্রাণটাকেই বুীদ দিতে হয়। এমনি করিয়া মানুষ যেটাকে সব চেয়ে বেশি চায় সেইটে হইতেই আপনাকে সব চেয়ে বেশি ফাকি দিতে থাকে।