পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী সংগৃহীত ও শ্রেণীবদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে এবং যাহা মুদীর্ঘকাল ধরিয়া ভিন্ন ভিন্ন পুরাণ সংকলন করিয়া স্বজাতির প্রাচীন পথটিকে চিহ্নিত করিয়া আসিয়াছে তাহ বিশেষ কোনো সময়ে সীমাবদ্ধ নহে। আর্ব অনার্ষের চিরন্তন সংমিশ্রণের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষের এই দুই বিরুদ্ধ শক্তি চিরকালই কাজ করিয়া আসিয়াছে; ইহাই আমাদের বক্তব্য । । *. একথা কেহ যেন না মনে করেন ষে অনার্যেরা আমাদিগকে দিবার মত কোনো জিনিস দেয় নাই। বস্তুত প্রাচীন ভ্রাবিড়গণ সভ্যতায় হীন ছিল না। তাহাদের সহযোগে হিন্দুসভ্যতা, রূপে বিচিত্র, ও রসে গভীর হইয়াছে। ভ্রাবিড় তত্ত্বজ্ঞানী ছিল না কিন্তু কল্পনা করিতে, গান করিতে এবং গড়িতে পারিত । কলাবিষ্ঠায় তাহারা নিপুণ ছিল এবং তাহাদের গণেশ দেবতার বধূ ছিল কলাবধূ। আর্যদের বিশুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে দ্রাবিড়ের রসপ্রবণতা ও রূপোস্তাবনী শক্তির সংমিশ্রণ-চেষ্টায় একটি বিচিত্র সামগ্রী গড়িয়া উঠিয়াছে। তাহ সম্পূর্ণ আৰও নহে সম্পূর্ণ অনার্থও নহে, তাহাই হিন্দু। এই দুই বিরুদ্ধের নিরস্তর সমন্বয়প্রয়াসে ভারতবর্ষ একটি আশ্চর্য সামগ্ৰী পাইয়াছে। তাহ অনন্তকে অস্তের মধ্যে উপলদ্ধি করিতে শিখিয়াছে এবং ভূমাকে প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত তুচ্ছতার মধ্যেও প্রত্যক্ষ করিবার অধিকার লাভ করিয়াছে। এই কারণেই ভারতবর্ষে এই দুই বিরুদ্ধ যেখানে না মেলে সেখানে মূঢ়তা ও অন্ধ সংস্কারের আর অস্ত থাকে না ; যেখানে মেলে সেখানে আনস্তের অন্তহীন রসরূপ আপনাকে অবাধে সর্বত্র উদঘাটিত করিয়া দেয়। এই কারণেই ভারতবর্ষ এমন একটি জিনিস পাইয়াছে যাহাকে ঠিকমত ব্যবহার করা সকলের সাধ্যায়ত্ত নহে, এবং ঠিকমত ব্যবহার করিতে না পারিলে যাহা জাতির জীবনকে মৃঢ়তার ভারে ধূলিলুষ্ঠিত করিয়া দেয়। আর্ব ও ত্রাবিড়ের এই চিত্তবৃত্তির বিরুদ্ধতার সম্মিলন যেখানে সিদ্ধ হইয়াছে সেখানে সৌন্দর্য জাগিয়াছে, যেখানে হওয়া সম্ভবপর হয় নাই সেখানে কদৰ্যতার সীমা দেখি না । একথাও মনে রাখিতে হইবে শুধু ভ্রাবিড় নহে, বর্বর অনার্ষদের সামগ্ৰীও একদিন দ্বার খোলা পাইয়া অসংকোচে আর্যসমাজে প্রবেশলাভ করিয়াছে। এই অনধিকার প্রবেশের বেদনাবোধ বহুকাল ধরিয়া আমাদের সমাজে সুতীব্র হইয়া ছিল । যুদ্ধ এখন বাহিরে নহে যুদ্ধ এখন দেহের মধ্যে—কেননা অন্ত্র এখন শরীরের মধ্যেই প্রবেশ করিয়াছে, শক্র এখন ঘরের ভিতরে। আর্ব সভ্যতার পক্ষে ব্ৰাহ্মণ এখন একমাত্র। এই জন্য এই সময়ে বেদ যেমন অভ্রান্ত ধর্মশাস্ত্ররূপে সমাজস্থিতির সেতু হইয়া দাড়াইল, ব্রাহ্মণও সেইরূপ সমাজে সর্বোচ্চ পূজ্যপদ গ্রহণের চেষ্টা করিতে লাগিল । তখনকার পুরাণে ইতিহাসে কাব্যে সর্বত্রই এই চেষ্টা এমনি প্রবল আকারে পুনঃপুন