পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ees রবীন্দ্র-রচনাবলী ত্যাগ-স্বীকারের বীরত্ব—এই কষ্ট তারই বেছিসাৰি বাজে খরচ। আজ তারই নিকাশ আমাদের চলিতেছে—ইহার ঋণের ফর্দটাই মোট । চোখের সামনে দেখিয়াছি হাজার হাজার মেয়েপুরুষ পুণ্যের সন্ধানে ঘে-পথ দিয়া মানে চলিয়াছে ঠিক তারই ধারে মাটিতে পড়িয়া একটি বিদেশী রোগী মরিল, সে কোন জাতের মানুষ জানা ছিল না বলিয়া কেহ তাহাকে ছুইল না। এই তো ঋণদায়ে দেউলিয়ার লক্ষণ। এই কষ্টসহিষ্ণু পুণ্যকামীদের নিষ্ঠা দেখিতে সুন্দর কিন্তু ইহার লোকসান সর্বনেশে। যে-অন্ধত মানুষকে পুণ্যের জন্য জলে স্নান করিতে ছোটায় সেই অন্ধতাই তাকে অজানা মুম্ষুর সেবায় নিরন্ত করে। একলব্য পরম নিষ্ঠুর স্রোণাচার্ধকে তার বুড়া আঙুল কাটিয়া দিল, কিন্তু এই অন্ধ নিষ্ঠার দ্বারা সে নিজের চিরজীবনের তপস্তাফল হইতে তার সমস্ত আপন জনকে বঞ্চিত করিয়াছে। এই ষে মূঢ় নিষ্ঠার নিরতিশয় নিফলতা, বিধাতা ইহাকে সমাদর করেন না—কেননা ইহা তার দানের অবমাননা । গয়াতীর্থে দেখা গেছে, ষে-পাণ্ডার না আছে বিদ্যা, না আছে চরিত্র, ধনী স্ত্রীলোক রাশি রাশি টাকা ঢালিয়া দিয়া তার পা পূজা করিয়াছে। সেই সময়ে তার ভক্তিবিহ্বলতা ভাবুকের চোখে মুন্দর কিন্তু এই অবিচলিত নিষ্ঠা, এই অপরিমিত বদান্তত কি সত্য দয়ার পথে এই স্ত্রীলোককে এক-পা অগ্রসর করিয়াছে। ইহার উত্তর এই যে, তবু তো সে টাকাট খরচ করিতেছে ; সে যদি পাণ্ডাকে পবিত্র বলিয়া না মানিত তবে টাকা খরচ করিতই না, কিম্বা নিজের জন্ত করিত। সে-কথা ঠিক,-কিন্তু তার একটা মস্ত লাভ হইত এই যে, সেই খরচ-না-করাটাকে কিম্বা নিজের জন্ত খরচ-করাটাকে সে ধর্ম বলিয়া নিজেকে ভোলাইত না,—এই মোহের দাসত্ব হইতে তার মন মুক্ত থাকিত। মনের এই মুক্তির অভাবেই দেশের শক্তি বাহিরে আসিতে পারিতেছে না। কেননা যাকে চোখ বুজিয়া চালানো অভ্যাস করানো হইয়াছে, চোখ খুলিয়া চলিতে তার পা কাপে, অমুগত দাসের মতো যে কেবল মনিবের জন্যই প্রাণ দিতে শিখিয়াছে, আপনি প্ৰভু হইয়া স্বেচ্ছায় স্যায়ধর্মের জন্য প্রাণ দেওয়া তার পক্ষে অসাধ্য। । এই জন্যই আমাদের পাড়াগায়ে অন্ন জল স্বাস্থ্য শিক্ষা আনন্দ সমস্ত আজ ভাটার মুখে। আত্মশক্তি না জাগাইতে পারিলে পল্লীবাসীর উদ্ধার নাই—এই কথা মনে করিয়া, . নিজের কল্যাণ নিজে করিবার শক্তিকে একটা বিশেষ পাড়ায় জাগাইবার চেষ্টা করিলাম। একদিন পাড়ায় আগুন লাগিল ; কাছে কোথাও এক ফোটা জল নাই ; পাড়ার লোক দাড়াইয়া ‘হায় হায়' করিতেছে। আমি তাদের বলিলাম, “নিজের মজুরি দিয়া যদি তোমরা পাড়ায় একটা কুলা খুঁড়িয়া দাও আমি তার বাধাইবার খরচ দিব।” তারা ভাবিল, পুণ্য হইবে ওই সেয়ান লোকটার, আর তার মজুরি জোগাইব