পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইংরেজি ভাষায়— অনেকদিন হইতে আমার কাছে তাহা একই কালে হাস্যকর ও দুঃখকর ঠেকিত। এবার নিরস্তর উৎপাত করিয়া আমরা এই অদ্ভুত কদাচার ভাঙিয়া দিয়াছিলাম। তাহাতে প্ৰবীণ দেশহিতৈষীর দল আমার উপর বিষম বিরক্ত হইয়াছিলেন। তঁহাদের সেই রুদ্রতায় যে কৌতুক ফেনিল হইয়া উঠিয়ছিল তাহার মধ্যে জগদিন্দ্রনাথের হাস্য প্রচুর পরিমাণে ছিল। সেবারে সব চেয়ে যাহা আমরা উপভোগ করিয়াছিলাম, সে তাহার আতিথ্যের আয়োজন নহে আতিথ্যের রস। সেই বিরাট যজ্ঞে উপকরণের বাহুলাই হইয়াছিল, কিন্তু সেটা বড়ো কথা নহে। এত বৃহৎ জনতার মধ্যে র্তাহার সঙ্গ তাহার সৌজন্য যে কেমন করিয়া সর্বব্যাপী হইয়া বিরাজ করিত, তাহাই আমার কাছে বিস্ময়ের বিষয়। আমাদের দেশে যজ্ঞকর্তার অবস্থা যে কিরূপ শোচনীয়, তাহা বাঙালি বরযাত্রীদের মেজাজ আলোচনা করিলেই বুঝা যায়। সময় চেষ্টা। সর্বজনীন কর্মানুষ্ঠানে সকল দলেরই যে সম্মিলিত দায়িত্ব সে কথা মনে থাকে না; লজ্জা মাত্র নাই। সেবারেও সেইরূপ বরযাত্র মেজাজের লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু প্রকোপ প্রশমনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের কর্তৃক অন্যায় রূপে লাঞ্ছিত হইয়াও মুহুর্তকালের জন্য র্তাহার প্রসন্নতা দূর হয় নাই। সভাধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে আর-এক অত্যাচারকারী অনাহূত অতিথির অকস্মাৎ আবির্ভাবে সকলের চমক লাগিল, সে আর কেহ নহে সেই বছরের ভূমিকম্প। সভা ভাঙিয়া গেল, পৃথিবীর শ্যামল গাত্রাবরণখানাকে কোন দৈত্য নখ দিয়া ছিড়িতে লাগিল, দালান ফাটিল- চারি দিকেই বিভীষিকা। বিয়ু বিপদ যাহা ঘটিবার তাহা তো ঘটিল, তাহার চেয়েও প্রবলতর পীড়া বাধাইল অনিশ্চিতের আশঙ্কা। রেলপথ বন্ধ, তারে খবর চলে না, অতিথিগণ সকলেই ঘরের খবরের জন্য উদবিগ্ন। দুৰ্দৈবের বড়ো ধাক্কাটা যখন থামিয়াছে তখনো ক্ষণে ক্ষণে ধরণীর হৃৎকম্প থামে না। পাকা কোঠায় থাকিতে কাহারো সাহস হয় না, চালা ঘরে কোনাে প্রকারে সকলের গোজামিলন। যিনি গৃহস্বামী এই দুর্বিপাকে নিঃসন্দেহই নিজের সংসারের জন্য তাহার উদবেগের সীমা ছিল না। কিন্তু নিজের ক্ষতি ও বিপত্তির চিন্তা তাহার মনের মধ্যে যে আলোড়িত হইতেছিল বাহির হইতে তাহা কে বুঝিবে? বিধাতা তাহার আতিথেয়তার যে কী কঠিন পরীক্ষা করিয়াছিলেন তাহা আমরা জানি, আর সেই পরীক্ষায় তিনি যে কিরূপ সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন তাহাও আমাদের মনে পড়ে। যে সৌজন্য, যে বৈদগ্ধ, যে আত্মমর্যাদাবোধ, যে সামাজিক আত্মোৎসর্গ আমাদের দেশের প্রাচীন অভিজাত বংশীয়ের উপযুক্ত, জগদিন্দ্রনাথের তাহা অজস্র ছিল, তাহার সঙ্গে ছিল আধুনিক যুগের শিক্ষা। জগদিন্দ্রনাথের চিত্তবিকাশে দুইটি বিদ্যার ধারার সমান মিলন দেখিয়াছি। সংস্কৃত শাস্তু ও সাহিত্যে তঁহার যেমন অগভীর আনন্দ ছিল, ইংরেজি সাহিত্যেও তাহার তেমনি ছিল অধিকার। এই অধিকার বাহিরের শিক্ষায় নহে অস্তরের ধারণাশক্তিতে। তাহার চিত্তরাজ্যে যাহা আমাদের মনকে সব চেয়ে আকর্ষণ করিয়াছিল, তাহা পাণ্ডিত্যের উপাদান নহে, তাহা সহজ সহৃদয়তায় প্রদীপ্ত রুচির আলোক। সংসারে সাধারণ আদৰ্শমতো ভালো লোক অনেকে আছেন, কিন্তু তাহাদিগকে মনে রাখিতে পারি না। র্তাহারা যেন গুণের তালিকা মাত্র। যে অলক্ষ্য সূত্রে সেই গুণগুলিকে এক করিয়া মানুষের ব্যক্তিস্বরূপটিকে পরিস্ফুট করিয়া তুলে, জগদিন্দ্রনাথের মধ্যে তাঁহাই ছিল। এইজন্য যখন তিনি ইহলোক হইতে চলিয়া গেলেন, বন্ধুদের স্মৃতিলোকে তাহার মূর্তি অম্লান ভাবে প্রতিষ্ঠিত রহিল। মানসী ও মৰ্ম্মবাণী মাঘ ১৩৩২ ৷৷