পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ br(? লর্ড সিংহ । অন্তরের দিক থেকে সব মানুষকে দেখবার সুযোগ ঘটে ওঠে না। সে-অবস্থায় মানুষটি বড়ো কি ছোটো তার বিচার করি মতের মিলের মাপকাঠি দিয়ে। যার সঙ্গে আমাদের মতের অনৈক্য তার সম্বন্ধে তামাদের মন কৃপণ দলের লোককে পুরস্কার দেওয়া আমাদের পক্ষে সহজ, কেননা সে পুরস্কারে । অনেকখানি নিজের উপর এসে পৌছয়। অস্তরের দিক থেকে সব মানুষকে যে আমরা দেখতে পাই নে তার প্রধান কারণ এ নয় যে, কাউকে কাছে থেকে দেখবার শবকাশ সাধারণত ঘটে না। অনেক ক্ষেত্রেই অন্তরের মানুষটি দেখবার মতো মানুষ নয়। দলের মধ্যে যে মানুষ কোনো প্রধান স্থান পেয়েছে সমস্ত দলের কাধের উপর চড়ে সে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু অস্তরের মানুষ একা, যদি সে আপন মহিমাতেই দেখা দিল সত্য বলে জানি, আত্মীয় বলে জানি। লর্ড সিংহকে দৈবক্রম কিছুদিন নিয়ত কাছে দেখতে পেয়েছি। গতবারে যুরোপ মহাদেশ ভ্ৰমণ করবার সময় তঁর সঙ্গলাভ করবার সুযোগ ঘটেছিল। ইংলন্ড থেকে আমরা একত্র যাত্রা করেছি নরোয়েতে। তিন দিন লেগেছিল পাড়ি দিতে- এই তিন দিন ধরে উত্তর সমুদ্র ঝড়ে তোলপাড়। ছােটাে জাহাজের ঝাকানি একেবারে অসহ্য, শোওয়া বসা দাঁড়ানো সমস্তই দুঃসাধ্য। ক্যাবিন থেকে এক মুহূর্ত বাইরে বেরোতে আমার সাহস হয় নি। সেই সময়ে প্রতিদিন প্রসন্নমুখে তিনি আমার খবর নিয়েছেন। কাজটা একটু মাত্র সহজ ছিল না— চলতে গিয়ে তিনি সিঁড়ির উপর আছড় খেয়েছেন, তবু এই কঠিন দুর্যোগে বিশেষ কষ্ট করে তিনি যে দেখা দিয়ে যেতেন সে তীর অকৃত্রিম সহৃদয়তার গুণে। সকল অবস্তাতেই তার মধ্যে যে সৌজন্য দেখেছি সে আচারগত নয়, সে হৃদয়গত। এই কারণে এই সৌজন্য তার একটি শক্তির অঙ্গ ছিল। এই শক্তিতে তিনি সহজে সর্বত্র প্রবেশাধিকার পেতেন। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা ত পেলেম নরোয়েতে যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হল সে পরিচয়ে অনায়াসে তিনি তাদের হৃদ্যতা লাভ করলেন- এই জিনিসটি সম্মানলাভের চেয়েও দুর্লভ। তিনি যে পদবী পেয়েছিলেন যুরোপীয় সমাজে সে পদবীর মূল্য যথেষ্ট বেশি। কিন্তু ওই পদবীর আড়ম্বর করতে তাকে একদিনও দেখি নি। আমরা একত্রে সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি ভ্ৰমণ করেছি, কিন্তু এই পদবী-গৌরবের লেশমাত্র চাঞ্চল্য, এই পদবীটাকে প্রত্যক্ষ করিয়ে সকলের অগ্রসর হয়ে চলবার চেষ্টা আমি কোথাও তীর মধ্যে একদিনের জন্যও অনুভব করি নি। যে আভিজাত্যের অভাবনীয় অধিকার তিনি পেয়েছিলেন সেই অধিকার যেন তীর নূতন পাওয়া সামগ্ৰী নয়, সে যেন তার সহজাত। তাতে করে তার স্বাভাবিক নম্রতাকে একটুমাত্র আবৃত করে নি। এর থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, লর্ড সিংহ আপনি স্বভাবে অত্যন্ত সত্য ছিলেন। বাইরের কিছুতেই এর থেকে তঁকে বিচলিত করতে পারে নি। দশের অনুবৃত্তি করা, ভিড়ের ঠেলায় চলা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এই কারণেই তার মধ্যে সম্মানের চাঞ্চল্য দেখিনি, এই কারণেই লোকমুখের বাহবাতেও তিনি অলুব্ধ ছিলেন। স্বভাবে তীর এই যে প্রতিষ্ঠা এর মধ্যে অন্ধ জেদের রূপ ছিল না, তার কারণ তীর বুদ্ধির অসামান্য স্বচ্ছতা। বরাবর নিজের পথ তিনি বিচার করেই স্থির করেছিলেন, ঝোকের মাথায় করেন নি। যে কয়দিন একত্রে ছিলাম, তীর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করবার অবকাশ ঘটেছিল। এইসব আলোচনায় যেটা আমি বিশেষ করে লক্ষ্য করেছি। সে হচ্ছে তাঁর চিত্তের শাস্ত ভাব। তিনি যা বুঝতেন বুদ্ধির আলোকে সে তিনি স্পষ্ট করে বুঝতেন, এইজন্যে তার মধ্যে তীর এমন শান্তি ছিল। গৌড়ামির মধ্যে এ শান্তি থাকে না। তাঁর চিস্তার মধ্যে এই অনুদ্ধত শাস্তি থাকাতেই আলোচনাকালে তার মতকে স্বীকার করে নেওয়া সহজ ছিল। জেদ ও গোঁড়ামির বন্ধুরতা যেখানে নেই, সেখানে এক মনের সঙ্গে আর-এক মনের চিস্তা চলাচলের পথ সুগম হয়