পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ò NR, রবীন্দ্র-রচনাবলী বিষবৃক্ষে কাহিনী এসে পৌঁছল আখ্যানে। যে-পরিচয় নিয়ে সে এল তা আছে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে। সাহিত্য থেকে অস্পষ্টতার আবরণ এক পর্দা উঠে গেল- ক্লাসিকাল অস্পষ্টতা বা রোম্যান্টিক অস্পষ্টতা অর্থাৎ ধ্রুপদী বা খেয়ালি দূরত্ব, সীতার বনবাসের ছাদ বা রাজপুতকাহিনীর ছাদ। মনে পড়ে আমার অল্প বয়সের কথা। তখন চোখে কম দেখতুম, অথচ জানতুম না যে কম দেখি। ওই কম দেখাটাকেই স্বাভাবিক বলে জানতুম, কোনো নালিশ ছিল না। এমন সময় হঠাৎ চশমা পরে জগৎটা যখন স্পষ্টতর হল তখন ভারি আনন্দ পেলুম। বিজয়বসন্তেও একদিন বাঙালি পাঠক সন্তুষ্ট ছিল, তখন সে জানত না গল্পে এর চেয়ে স্পষ্টতর জগৎ আছে। তার পরে দুর্গেশনন্দিনীতে চমক লাগল, এটা তার কাছে অভূতপূর্ব দান। কিন্তু তখনো ঠিক চশমাটি সে পায় নি, তবু দুঃখ ছিল না, কেননা, জানত না যে সে পায় নি। এমন সময়েই বিষবৃক্ষ দেখা দিল। কৃষ্ণকাস্তের উইল সেই জাতেরই, সে যেন আরো স্পষ্ট। তার পরে এলেন প্রচারক বন্ধিম। আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরানী, সীতারাম, একে একে আসরে এসে উপস্থিত, গল্প বলবার জন্যে নয়, উপদেশ দেবার জনো! আবার অস্পষ্টতা সাধু অভিপ্ৰায়ের গৌরবগর্বে সাহিত্যে উচ্চ আসন অধিকার করে বসল। আনন্দমঠ আদর পেয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যরসের আদর সে নয়, দেশাভিমানের। এক-এক সময়ে জনসাধারণের মন যখন রাষ্ট্রিক বা সামাজিক বা ধর্মসাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বিচলিত হয়ে থাকে সেই সময়টা সাহিত্যের পক্ষে দুর্যোগের সময়। তখন পাঠকের মন অল্পেই ভোলানো চলে। গুটুকি মাছের প্রতি আসক্তি যদি অত্যন্ত বেশি হয় তা হলে রাধবার নৈপুণ্য অনাবশ্যক হয়ে ওঠে। ওই জিনিসটার গন্ধ থাকলেই তরকারির আর অনাদর ঘটে না। সাময়িক সমস্যা এবং চলতি সেন্টিমেন্ট, সাহিত্যের পক্ষে কচুরিপানার মতোই, তাদের জন্যে আবাদের প্রয়োজন হয় না, রসের স্রোতকে আপনি জোরেই আচ্ছন্ন করে দেয়। আধুনিক যুরোপে এই দশা ঘটেছে— সেখানে আর্থিক সমস্যা, স্ত্রী-পুরুষের সমস্যা, বিজ্ঞান ও ধর্মের দ্বন্দ্ব-সমস্যায় সমাজে একটা বিপৰ্যয় কাণ্ড চলছে। লোকের মন তাতে এত বেশি। প্রবলভাবে ব্যাপৃত যে, সাহিত্যে তাদের অনধিকারপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা দায়, নভেলগুলি গল্পের মালমসলামাখা প্রবন্ধ হয়ে উঠল। এতে করে সাহিত্যে যে স্তুপাকার আবর্জনা জমে উঠেছে সেটা আজকের পাঠকদের উপলব্ধিতে পোঁচাচ্ছে না, কেননা, আজ সাহিত্যের বাহিরের মাল নিয়ে তাদের মন যোলো-আনা ভর্তি হয়ে রয়েছে। আর-এক যুগে এই-সব আবর্জনা বিদায় করবার জন্যে গাড়িতে যমের বাহন মহিষ অনেকগুলো জুৎতে হবে। আমার বক্তব্য এই যে আর্টিস্টের, সাহিত্যিকের প্রধান কাজ হচ্ছে দেখানো, বিশ্বরসের পরিচয়ে আবরণ যত কিছু আছে তাকে অপসারণ করা। রসের জগৎকে স্পষ্ট করে মানুষের কাছে এনে দেওয়া, মানুষের একান্ত আপন করে তোলা। সীতার বনবাস ইস্কুলে পড়েছিলেম নয়--', ওটা ঘরের। বিশ্বে আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ করবার জন্যেই সাহিত্য। বিষবৃক্ষের পর কৃষ্ণকাস্তের উইলের পর অনেক দিন কেটে গেল। আবার দেখি গল্পসাহিত্যে আর-একটা যুগ এসেছে। অর্থাৎ আরো একটা পর্দাঁ উঠল। সেদিন যেমন ভিড় করে রবাহতের দল জুটেছিল সাহিত্যের প্রাঙ্গণে আজও তেমনি জুটেছে। তেমনি উৎসাহ, তেমনি আনন্দ, তেমনি জনতা। এবারে নিমন্ত্রণকর্তা শরৎচন্দ্র। তীর গল্পে যে-রসকে তিনি নিবিড় করে জুগিয়েছেন সে হচ্ছে সুপরিচয়ের রস। তঁর সৃষ্টি পূর্বের চেয়ে পাঠকের আরো অনেক কাছে এসে পৌঁছল। তিনি নিজে দেখেছেন বিস্তুত করে, স্পষ্ট করে, দেখিয়েছেন তেমনি সুগোচর করে। তিনি রঙ্গমঞ্চের পট উঠিয়ে দিয়ে বাঙালি সংসারের যে আলোকিত দৃশ্য উদ্ঘাটিত করেছেন সেইখানে আধুনিক লেখকদের প্রবেশ সহজ হল। তাদের আনাগোনাও চলছে। একদিন তারা হয়তো সে কথা ভুলবে এবং তাকে স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু আশা করি পাঠকেরা