পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NiVo রবীন্দ্র-রচনাবলী যায় যে, নিজের জাতের 'পরে তার নিজের মনেই সম্মানের অভাব আছে। বাংলা ভাষাকে প্রায় সংস্কৃত বলে চালালে তার গলায় পৈতে চড়ানাে হয়। দেশজ বলে কারো কারো মনে বাংলার 'পরে যে অবমাননা আছে সেটাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নামাবলী দিয়ে ঢেকে দেবার চেষ্টা অনেকদিন আমাদের মনে আছে। বালক বয়সে যে ব্যাকরণ পড়েছিলুম তাতে সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা দিয়ে বাংলা ভাষাকে শোধন করবার প্রবল ইচ্ছা দেখা গেছে; অর্থাৎ এই কথা রটিয়ে দেবার চেষ্টা, যে, ভাষাটা পতিত যদি বা হয় তবু পতিত ব্ৰাহ্মণ, অতএব পতিতের লক্ষণগুলো যতটা পারা যায়, চােখের আড়ালে রাখা কর্তব্য। অন্তত পুঁথিপত্রের চালচলনে বাংলা দেশে মস্ত ভিড়কে কোথাও যেন কবুল করা না হয় স্বাগত বলে যেন এগিয়ে নিয়ে আসা হয় ‘মহতী জনতা’কে । এমনি করে সংস্কৃতভাষা অনেককাল ধরে অপ্রতিহত প্রভাবে বাংলা ভাষাকে অপত্য নির্বিশেষে শাসন করবার কাজে লেগেছিলেন। সেই যুগে নর্মাল স্কুলে কোনােমতে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পর্যন্ত আমার উন্নতি হয়েছিল। বংশে ধনমর্যাদা না থাকলে তাও বোধহয় ঘটত না। তখন যে ভাষাকে সাধুভাষা বলা হত অর্থাৎ যে ভাষা ভুল করে আমাদের মাতৃভাষার পাড়ায় পা দিলে গঙ্গাস্নান না করে ঘরে ঢুকতেন না তার সাধনার জন্যে লোহারাম শিরোরত্নের ব্যাকরণ এবং আদ্যনাথ পণ্ডিতমশায়ের ‘সমাসব্দৰ্পণ” আমাদের অবলম্বন ছিল। আজকের দিনে শুনে সকলের আশ্চর্য লাগবে যে, দ্বিগু সমাস কাকে বলে সুকুমারমতি বালকের তাও জানা ছিল। তখনকার কালের পাঠ্যগ্রন্থের ভূমিকা দেখলেই জানা যাবে সেকালে বালকমাত্রই সুকুমারমতি ছিল। ভাষা সম্বন্ধে আর্যপদবীর প্রতি লুব্ধ মানুষ আজও অনেকে আছেন, শুদ্ধির দিকে তঁদের প্রখর দৃষ্টি— তাই কান সোনা পান চুনের উপরে তীরা বহু যত্নে মূর্ধন্য ণ-য়ের ছিটে দিচ্ছেন তার অপভ্ৰংশতার পাপ যথাসাধ্য পালন করবার জন্যে। এমন-কি, ফার্সি দরুন' শব্দের প্রতিও পতিতপাবনের করুণা দেখি। গবর্নমেন্টে-র উপর ণত্ব বিধানের জোরে তারা ভগবান পাণিনির আশীৰ্বাদ টেনে এনেছেন। এদের ‘পরনে 'নরুণ-পেড়ে’ ধুতি। ভাইপো হিরোনে'র নামটাকে কোন ন-এর উপর শূলে চড়াবেন তা নিয়ে দাে-মনা আছেন। কানে কুণ্ডলের সোনার বেলায় তঁরা আর্য কিন্তু কানে মন্ত্র শোনার সময় তঁরা অন্যমনস্ক। কানপুরে মূর্ধন্য ণ চড়েছে তাও চােখে পড়ল- অথচ কানাই পাহারা এড়িয়ে গেছে। মহামারী যেমন অনেকগুলোকে মারে অথচ তারই মধ্যে দুটা-একটা রক্ষা পায়, তেমনি হঠাৎ অল্পদিনের মধ্যে বাংলায় মূর্ধন্য ণ অনেকখানি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। যাঁরা সংস্কৃতভাষায় নতুন গ্র্যাজুয়েট এটার উদ্ভব তাদেরই থেকে, কিন্তু এর ছোয়াচ লাগল ছাপাখানার কম্পোজিটরকেও। দেশে শিশুদের 'পরে দয়া নেই। তাই বানানে অনাবশ্যক জটিলতা বেড়ে চলেছে। অথচ তাতে সংস্কৃতভাষার নিয়মও পীড়িত বাংলার তো কথাই নেই। প্রাচীন ভারতে প্রকৃত ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল। যাঁরা লিখেছিলেন তীরা আমাদের চেয়ে সংস্কৃত ভাষা কম জানতেন না। তবু তারা প্ৰকৃতকে নিঃসংকোচে প্রকৃত বলেই মেনে নিয়েছিলেন, লজ্জিত হয়ে থেকে থেকে তার উপরে সংস্কৃত ভাষার পলস্তারা লাগান নি। যে প্রমাণ করতে চান নি যে ইরাবতী চন্দ্ৰভাগা শতদ্রু গঙ্গা যমুনা ব্ৰহ্মপুত্র সমস্তই হিমালয়ের মাথার উপরে জমাট-করা বিশুদ্ধ বরফেরই পিণ্ড। যারা যথার্থ পণ্ডিত তারা অনেক সংবাদ রাখেন বলেই যে মান পাবার যোগ্য তা নয় তাদের স্পষ্ট দৃষ্টি। যে-কোনাে বিষয় শাস্ত্রীমশায় হাতে নিয়েছেন তাকে সুস্পষ্ট করে দেখেছেন ও সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। বিদ্যার সংগ্ৰহ ব্যাপার অধ্যবসায়ের দ্বারা হয়। কিন্তু তাকে নিজের ও অন্যের মনে সহজ করে তোলা ধীশক্তির কাজ। এই জিনিসটি অত্যন্ত বিরল। তবু, জ্ঞানের বিষয় প্রভূত