পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>のS রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখতে পাওয়া যায় না। পরে জানতে পেরেছি। এগুলি জগদানন্দের লেখা, তিনি তার স্ত্রীর নাম দিয়ে পাঠাতেন। তখনকার দিনে বৈজ্ঞানিক সমস্যার এরূপ সুন্দর উত্তর কোনাে স্ত্রীলোক এমন সহজ করে লিখতে পারেন ভেবে বিস্ময় বোধ করেছি। একদিন যখন জগদানন্দের সঙ্গে পরিচয় হল তখন তীর দুঃস্থ অবস্থা এবং শরীর রুগুণ। আমি তখন শিলাইদহে বিষয়কর্মেরত। সাহায্য করবার অভিপ্ৰায়ে তীকে জমিদারি কর্মে আহবান করলেম। সেদিকেও তীর অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্ব ছিল। মনে আক্ষেপ হল— জমিদারি সেরেস্তা তার উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র নয়, যদিও সেখানেও বড়ো কাজ করা যায়। উদার হৃদয় নিয়ে। জগদানন্দ তার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে তিনি বারংবার জুরে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হল তঁকে বাঁচানাে শক্ত হবে। তখন তীকে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে আহবান করে নিলুম শান্তিনিকেতনের কাজে। আমার প্রয়োজন ছিল এমন সব লোক, যার সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদেরকে আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলা বাহুল্য, এরকম মানুষ সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক। স্বল্পায়ু কবি সতীশ রায় তখন বালক, বয়স উনিশের বেশি নয়। সেও এসে এই আশ্রমগঠনের কাজে উৎসর্গ করলে আপনাকে। এর সহযোগী ছিলেন মনােরঞ্জন বড়জো, এখন ইনি সম্বলপুরের উকিল, সুবােধচন্দ্র মজুমদার, পরে ইনি জয়পর স্টেটে কর্মগ্রহণ ক’রে মারা গিয়েছেন। কিন্তু জগদানন্দের সেই দূর্লভ গুণ ছিল যাঁর প্রেরণায় কাজের মধ্যে তিনি হৃদয় দিয়েছেন। তীর কােজ আনন্দের কাজ ছিল, শুধু কেবল কর্তব্যের নয়। তার প্রধান কারণ, তার হৃদয় ছিল সরস, তিনি ভালোবাসতে পারতেন। আশ্রমের বালকদের প্রতি র্তার শাসন ছিল বাহ্যিক, মেহ ছিল চান— নিকট পরিচয়ে ছেলেদের কাছে তাদের মান বজায় থাকবে না। এই আশঙ্কা তাদের ছাড়তে চায় না। জগদানন্দ একই কালে ছেলেদের সুহৃদও ছিলেন সঙ্গী ছিলেন। অথচ শিক্ষক ছিলেন অধিনায়ক ছিলেন – ছেলেরা আপনারাই তীর সম্মান রেখে চলত।— নিয়মের অনুবর্তী হয়ে নয়, অস্তরের শ্রদ্ধা থেকে। সন্ধ্যার সময় ছাত্রদের নিয়ে তিনি গল্প বলতেন। মনোজ্ঞ করে গল্প বলবার ক্ষমতা তীর ছিল। তিনি ছিলেন যথার্থ হাস্যরসিক, হাসতে জানতেন। তার তর্জনের মধ্যেও লুকোনো থাকত হাসি। সমস্ত দিন কর্মের পর ছেলেদের ভার গ্রহণ করা সহজ নয়। কিন্তু তিনি তীর নির্দিষ্ট কর্তব্যের সীমানা অতিক্রম করে স্বেচ্ছায় স্নেহে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করতেন। অনেকেই জানেন ক্লাসের বাইরেও ছেলেদের ডেকে ডেকে তাদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে কখনোই তিনি আলস্য করতেন না। নিজের অবকাশ নষ্ট করে অকাতরে সময় দিতেন তাদের জন্যে । কর্তব্যসাধনের দ্বারা দাবি চুকিয়ে দিয়ে প্রশংসা লােভ চলে। কর্তব্যনিষ্ঠতাকে মূল্যবান বলেই লোকে জানে। দাবির বেশি যে দান সেটা কর্তব্যের উপরে, সে ভালোবাসার দান। সে অমূল্য, মানুষের চরিত্রে যেখানে অকৃত্রিম ভালোবাসা সেইখনেই তার অমৃত। জগদাননেন্দর স্বভাবে দেখেছি সেই ভালোবাসার প্রকাশ, যা সংসারের সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে তাকে চিরস্তানের সঙ্গে যোগযুক্ত করেছে। আশ্রমে এই ভালোবাসা-সাধনার আহবান আছে। নির্দিষ্ট কর্মসাধন করে তার পর ছুটি নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে নিজেকে বদ্ধ রাখতে চান যাঁরা, সেরকম শিক্ষকের সত্তা এখানে ক্ষীণ অস্পষ্ট। এমন লোক এখানে অনেক এসেছেন গেছেন পথের পথিকের মতো। তঁরা যখন থাকেন তখনো তারা অপ্রকাশিত থাকেন, যখন যান। তখনো কোনো চিহ্নই রেখে যান না। এই যে আপনার প্রকাশ, এ ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন- এ প্রকাশ ভালোবাসায়, কেননা, ভালোবাসাতেই আত্মার পরিচয়। জগদানন্দের যে দান যে প্রণবান, সে শুধু স্মৃতিপটে চিহ্ন রাখে না, তা একটি সক্রিয় শক্তি বা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে যায়। আমরা জানি বা না-জানি বিশ্ব