পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ンのど রবীন্দ্র রচনাবলী তার পথ তৈরি করতে থাকে। সৃষ্টিকার্যে জীবনীশক্তির এই অস্থিরতা নন্দলালের প্রকৃতিসিদ্ধ। কোনো একটা আড়ায় পৌঁছে আর চলবেন না, কেবল কেদারায় বসে পা দোলাবেন, তার ভাগ্যলিপিতে তা লেখে না। যদি তার পক্ষে সেটা সম্ভবপর হত তা হলে বাজারে তার পসার জমে উঠত। যারা বাঁধা খরিদদার তাদের বিচারবুদ্ধি আচল শক্তিতে খুঁটিতে বাঁধা। তাদের দরযাচাই প্রণালী অভ্যস্ত আদর্শ মিলিয়ে। সেই আদর্শের বাইরে নিজের রুচিকে ছাড়া দিতে তারা ভয় পায়, তাদের ভালো লাগার পরিমাণ জনশ্রুতির পরিমাণের অনুসারী। আর্টিস্টের কাজ সম্বন্ধে জনসাধারণের ভালো লাগার অভ্যাস জমে উঠতে সময় লাগে। একবার জমে উঠলে সেই ধারার অনুবর্তন করলে আর্টিস্টের আপদ থাকে না। কিন্তু যে আত্মবিদ্রোহী শিল্পী আপন তুলির অভ্যাসকে ক্ষণে ক্ষণেঅ ভাঙতে থাকে, আর যাই হােক, হাটে-বাজারে তাকে বারে বারে ঠকতে হবে। তা হােক, বাজারে ঠিক ভালো, নিজেকে ঠকানো তো ভালো নয়। আমি নিশ্চিত জানি, নন্দলাল সেই নিজেকে ঠকাতে অবজ্ঞা করে, তাতে তীর লোকসান যদি হয় তো হোক। অমুক বই বা অমুক ছবি পর্যন্ত লেখক বা শিল্পীর উৎকর্ষের সীমা— বাজারে এমন জনরব মাঝে মাঝে ওঠে, অনেক সময়ে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, লোকের অভ্যস্ত বরাদ্দ বিয়ু ঘটেছে। সাধারণের অভ্যাসের বাধা জোগানদার হবার লোভ সামলাতে না পারলে সেই লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর যাই হােক সেই পপলোভের আশঙ্কা নন্দলালের একেবারেই নেই। তার লেখনী নিজের অতীত কালকে ছাড়িয়ে চলবার যাত্ৰিণী। বিশ্বসৃষ্টির যাত্রাপথ তো সেই দিকেই, তার অভিসার অন্তহীনের আহবানে। আটিস্টের স্বকীয় আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় তীর চরিত্রে তার জীবনে। আমরা রংবার তার প্রমাণ পেয়ে থাকি নন্দলালের স্বভাবে। প্রথম দেখতে পাই আর্টের প্রতি তার সম্পূর্ণ নির্লোেভ নিষ্ঠা। বিষয়বৃদ্ধির দিকে তীর আকাঙক্ষার দৌড় থাকত, তা হলে সেই পথে অবস্থার উন্নতি হবার সুযোগ তীব্র যথেষ্ট ছিল। প্রতিভার সাচ্চাদামি-যাচাইয়ের পরীক্ষক ইন্দ্রদেব শিল্প-সাধকদের তপস্যার সম্মুখে রজত নৃপুরনিক্কণের মোহজাল বিস্তার করে থাকেন, সরস্বতীর প্ৰসাদস্পর্শ সেই লোভ থেকে রক্ষা করে, দেবী অর্থের বন্ধন থেকে উদ্ধার করে সার্থকতার মুক্তিবর দেন। সেই মুক্তিলোকে বিরাজ করেন নন্দলাল, তার ভয় নেই। র্তার স্বাভাবিক। আভিজাত্যের আর-একটি লক্ষণ দেখা যায়, সে তীর অবিচলিত ধৈৰ্য। বন্ধুর মুখের অন্যায় নিন্দাতেও তীর প্রসন্নত ক্ষুন্ন হয় নি তার দৃষ্টােস্ত দেখেছি। যারা তীকে জানে এমনতরো ঘটনায় তারাই দুঃখ পেয়েছে, কিন্তু তিনি অতি সহজেই ক্ষমা করতে পেরেছেন। এতে তার অস্তরের ঐশ্বৰ্য সপ্রমাণ করে। তার মন গরীব নয়। তার সমব্যবসায়ীর কারো প্রতি ঈর্ষার আভাসমােত্র তীর ব্যবহারে প্রকাশ পায় নি। যাকে যার দেয় সেটি চুকিয়ে দিতে গেলে নিজের যশে কম পড়বার আশঙ্কা কোনোদিন তাকে ছোটাে হতে দেয় নি। নিজের সম্বন্ধে ও পরের সম্বন্ধে তিনি সত্য; নিজেকে ঠকান না ও পরকে বঞ্চিত করেন না। এর থেকে দেখতে পেয়েছি রাখতে চান না। শিল্পী ও মানুষকে একত্র জড়িত করে আমি নন্দলালকে নিকটে দেখেছি। বুদ্ধি, হৃদয়, নৈপুণ্য অভিজ্ঞতা ও অস্তদৃষ্টির এরকম সমাবেশ অল্পই দেখা যায়। তীর ছাত্র, যারা তীর কাছে শিক্ষা পাচ্ছে, তারা এ কথা অনুভব করে এবং তাঁর বন্ধু যারা তাকে প্রত্যহ সংসারের ছোটাে বড়ো নানা ব্যাপারে দেখতে পায় তারা তাঁর ঔদার্য্যে ও চিত্তের গভীরতায় তীর প্রতি আকৃষ্ট। নিজের ও তাদের হয়ে এই কথাটি জানাবার আকাঙক্ষা আমার এই লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। এরকম প্রশংসার তিনি কোনো অপেক্ষা করেন না, কিন্তু আমার নিজের মনে এর প্রেরণা অনুভব করি। fsä| ष् $७8०