পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Σ Σ Ο রবীন্দ্র রচনাবলী জন্যে আমরা সবাই মিলেছি, তীকে শোকের মায়া বা মৃত্যুর ছায়া দিয়ে গড়ে তোেলবার দরকার নেই। তার চরিত্রের দীপ্তি সহজেই আত্মপ্রকাশ করেছে, কারো কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় নি। বস্তুত এ যে নারী, যিনি চিরজীবন আপনি স্তব্ধতার মধ্যে সমাহিত থেকে পরম দুঃখ নীরবে বহন করেছেন, তার পরিচয়ের দীপ্তি কেমন করে যে আজ স্বতঃই সমস্ত ভারতে ব্যাপ্ত হল। সে কথা চিন্তা করে মন বিস্মিত হয়। আধুনিককালে কোনাে রমণীকে জানি নে, যিনি মৃত্যুকে অতিক্রম করে অনতিকালের মধ্যে সমস্ত দেশের সম্মুখে এমন অমৃত মূর্তিতে আবির্ভূত হতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠিত হবার অধিকারী। অপরিসীম তীর ধৈর্য, বীরত্ব তীর বিরাট— কিন্তু সকলের চেয়ে বড়ো তীর সুদৃঢ় সত্যনিষ্ঠা। পলিটিক্সের সাধনায় আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলেন নি। সত্য যেখানে বিপদজনক, সেখানে সীতাকে তিনি ভয় করেন নি, মিথ্যা যেখানে সুবিধাজনক সেখানে তিনি সহায় করেন নি মিথ্যাকে। মিথ্যার উপচার আশু প্রয়ােজনবােধে দেশপূজার যে অর্ঘ্যে অসংকোচ স্বীকৃত হয়ে থাকে, সেখানে তিনি সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করেছেন। তাঁর অসামান্য বুদ্ধি কূটকৌশলের পথে ফললাভের চেষ্টাকে চিরদিন ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করেছে। দেশের মুক্তি সাধনায় তীর এই চরিত্রের দান সকলের চেয়ে বড়ো দান। কমলা ছিলেন জওহরলালের প্রকৃত সহধর্মিণী। তাঁর মধ্যে ছিল, সেই অপ্ৰমত্ত শাস্তি, সেই অবিচলিত স্থৈৰ্য, যা বীর্যের সর্বোত্তম লক্ষণ। তাদের দুজনের কারো মধ্যে দেখি নি অতি ভাবালুতার চঞ্চল উত্তেজনা। তঁদের এমন পরিপূর্ণ মিলনে কী জীবনে কী মৃত্যুতে বিচ্ছেদের স্থান নেই। নিশ্চয়ই আজ তার স্বামী মরণের মধ্যে দিয়ে কমলাকে দ্বিগুণ করে লাভ করেছেন। যিনি তার জীবনসঙ্গিনী ছিলেন, আজও তিনি তার জীবনসঙ্গিনী রইলেন। দূর অতীতের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষণিকায় আমরা পুরাণ-বিখ্যাত সাধ্বী ও বীরাঙ্গনাদেরকে তাদের বিরাট স্বরূপে দেখতে পাই। কমলা নেহরু আজও কালের সেই পরিপ্রেক্ষণিকায় উত্তীর্ণ হন নি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিকটবর্তী বর্তমানের প্রত্যক্ষগোচর; এখানে বড়োর সঙ্গে ছোটো, মূল্যবানের সঙ্গে অকিঞ্চিৎকর জড়িত হয়ে থাকে। তৎসত্তেও আমরা তার মধ্যে দেখছি যেন একটি পৌরাণিক মহিমা; তিনি তার আপন মহত্তের পরিপ্রেক্ষণিকায় নিতারূপে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশমান। আজ হােলির দিন আজ সমস্ত ভারতে বসন্তোৎসব। চারি দিকে শুষ্কপত্র ঝরে পড়ছে, তার মধ্যে নবকিশলয়ের অভিনন্দন। আজ জরা-বিজয়ী নূতন প্রাণের অভ্যর্থনা জলে স্থলে আকাশে। এই উৎসবের সঙ্গে আমাদের দেশের নব-জীবনের উৎসবকে মিলিয়ে দেখতে চাই। আজি অনুভব করব যুগসন্ধির নির্মম শীতের দিন শেষ হল, এল নবযুগের সর্বব্যাপী আশ্বাস। আজ এই নবযুগের ঋতুরাজ জওহরলাল। আর আছেন বাসস্তলক্ষ্মী কমলা তীর সঙ্গে অদৃশ্যসজ্ঞায় সম্মিলিত। তাদের সমস্ত জীবন দিয়ে ভারতে যে বসন্ত সমাগম তারা ঘোষণা করেছেন, সে তো অনায়াস আরামের দিক দিয়ে করেন নি। সাংঘাতিক বিরুদ্ধতার প্রতিবাদের ভিতর দিয়েই তারা দেশের শুভ-সূচনা করেছেন। এইজনে আমাদের আশ্রমে এই বসন্তোৎসবের দিনকেই সেই সাধবীর স্মরণের দিনরূপে গ্রহণ করেছি। তারা আপন নির্ভীক বীর্যের দ্বারা ভারতে নবজীবনের বসন্তের প্রতীক। এই নারীর জীবনে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রতিদিন যে দুঃসহ সংগ্রাম চলেছিল, যে-সংগ্রামে তিনি কোনোদিন পরাভব স্বীকার করেন নি, সে আমাদের গৌরবের সঙ্গে স্মরণীয়। স্বামীর সঙ্গে দুর্বিষহ দুঃখের দিনেও স্বামীকে তিনি পিছনের দিকে ডাকেন নি, নিজের কথা ভুলে সংকটের মুখ থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে তীকে বেদন জানান নি। স্বামীর ব্রতরক্ষা তিনি আপন প্রাণরক্ষার চেয়ে বড়ো করে জেনেছিলেন। এই দুষ্কর সাধনার জোরে তিনি আজও, মৃত্যুর পরেও