পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আজকার এই ভক্তের প্রতি শ্ৰদ্ধাপ্রকাশের সভায় সভাপতির কার্যের আমি একান্ত অযোগ্য। আজকার সভায় অনেক প্রবীণ ভক্তজন উপস্থিত, যাহারা স্বগীয় মহাত্মার সঙ্গী ছিলেন, যাঁহাদের ভক্তির সুরে সুর বঁধিলে ভক্তের গুণগান ভালো শুনাহঁত, তীহাদের উপস্থিতিতে আমার এ কাৰ্যভার গ্রহণ করা একান্তই অযোগ্যপাত্রে ভারাপণ হইয়াছে। যেমন কখনো কখনো নীেকার মাঝি একজন দাঁড়িকে হাল দিয়া নিজে দাঁড় টানিতে থাকে, তেমনি আজ আমাকে সভাপতির আসন দেওয়া হইয়াছে। আমার নানা অযোগ্যতা সত্ত্বেও কেবল একটি কারণে আমি এ কার্যভার গ্রহণে সম্মত হইয়াছি। পৃথিবীতে জনসমাজের পাপ দুৰ্গতি নাশের জন্য সাধু মহাত্মারা আসিয়া থাকেন। পরবর্তী সময়ের লোকেরা মনে করে যে আহা আমি যদি সেই সময়ে জন্মগ্রহণ করিতাম তবে সৌভাগ্যবান হইতাম। আমি এই ভক্তের সময়ে জন্মিয়াও তীর সঙ্গলাভের সৌভাগ্য ভোগ করিতে পারি নাই। তিনি যখন স্বগীয় জ্যোতিতে উদ্দীপ্ত হইয়া হিন্দু আত্মীয়গণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলেন, এবং আমার পিতৃগৃহে বাস করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন তিনি সদ্যপ্রসূত শিণ্ড। তার পর যখন আমি বালক, কিছু কিছু জ্ঞান হইয়াছে, তখন ব্রাহ্মসমাজে বিরোধের সময়। আমার মনেও সেই বিরোধের ভাব। আমার মনে হইত, তিনি যে ধর্ম, যে সত্য প্রচার করিতেছেন, তাহা আমাদের স্বদেশীয় নয়, বিদেশী। তাকে নিয়ে যখন খুব গোলমাল হচ্ছে তখন তীর প্রতি আমার একটি বিরোধভােব এসেছিল এটা আমার বেশ মনে আছে। আমারও মনে হয়েছিল তিনি যেন আমার দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আর আজ দেখছি মহত্ত্বের প্রকাশ বিরোধভাবের মধ্যে দিয়েই হয়ে থাকে। স্বীকার করতে হবে আমার অস্তরের ভেতরে বিরোধভাবের সঞ্চার আমার বালককাল হতেই হয়েছিল। যেমন দেখা যায় ধোঁয়ার প্রাচুর্যবশত আগুনকে দেখা যায় না, আমি তেমনি তখন তীর তেজের কিছুই দেখতে পাই নি। যে-সকল মহাপুরুষ আমার জীবনকালের মধ্যেকার, তাদের চেনবার আমাদের অবকাশ হয় নি, সেই ভাগ্যহীনতার অবস্থা জীবনে ঘটেছিল এ কথা বলতেই হবে। যে মহাপুরুষের কীর্তি বলতে এসেছি তীর সঙ্গে আমাদের যোগ ছিল অথচ কী একটা কুহেলিকা এসেছিল যে তীর সঙ্গে সে যোগস্থাপন করতে পারি নি। আজ তাই তীর স্মৃতিসভায় তার কাছে ভক্তি নিবেদন করতে এলাম। এজন্যই সভাপতি হওয়া। যাঁরা তীর কাছে ছিলেন, তাদের কথা বহুমূল্য ও যথার্থ। সে মহাপুরুষের কিছু দান করতে আমার অধিকার নাই। আমার এমন কোনো সুযোগ হয় নাই যে আর কোনো দিন কোনোরকমে তীর প্রতি ভক্তি মোটেই কোনাে সুযোগ হবার সম্ভাবনা নাই, তাই আমি আজ সভাপতি হয়ে তীর প্রতি ভক্তি জানাতে সুযোগ নিলাম। তীর বিষয়ে যে তখন একটা বিরোধভােব আমার মনে এসেছিল তার একটা কারণও আছে। তখন আমার মনে হত বুঝি আমাদের স্বদেশের যে মহাত্মা আছে, বুঝি সেই মহাপুরুষ সে গীেরবের কিছু ব্যাঘাত করেছেন, বিদেশী সত্যের মাহাত্ম্য বুঝি এত বড়ো করে প্রকাশ করেছেন, তাতে বুঝি আমাদের গীেরব খর্ব করেছেন। তখন বোল ছিল স্বদেশী। এই তখন দম্ভ, দৰ্প ছিল। একটা ধারণা ছিল আমার, সকলেরই হয়, যে যিনি যে দেশের মহাপুরুষ তিনি সে দেশের বাণী সকল বলতে বাধ্য। যখন কেউ স্বদেশের বাণী না বলে, বিদেশী কোনো মহাপুরুষের বাণী, জ্যোতিঃলাভের কথা বলেছেন তখনই সকলে মনে করেছে ইনি বুঝি বিরুদ্ধবাদী। এ হয়েই থাকে। আর তারা আসেনই সেই সময় যখন আমাদের স্বলন হয়েছে, আমরা যখন ঘোর অন্ধকারে একেবারে তলিয়ে যাচ্ছি— তখনই তারা জন্মগ্রহণ করেন— তাই মানুষ বোঝে যেটা আমাদের লোকচার, এখনকার ধর্ম, ইনি তার বিরুদ্ধে বলেছেন, সাধারণত