পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S\0S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সৃষ্টি হইয়াছে। রাজনারায়ণবাবুর জীবনে এই আনন্দরসের প্রাচুর্য ছিল। যাহাকে কিছু উৎপন্ন করিতে হয় তাহার নিজের পদতলের ভূমির উপর শ্রদ্ধা থাকা চাই। এই ভূমি বালুকাময়, এই ভূমি অসার, এইরূপ যিনি মনে করেন তাহার ভূমিকৰ্ষণ ও শস্যোৎপাদনে মনোযোগ হয় না। এই দেশের প্রতি রাজনারায়ণবাবুর শ্রদ্ধা ছিল; শ্রদ্ধা ছিল বলিয়াই তিনি এই দেশের মঙ্গলের জন্য বিবিধ কাৰ্য করিতে পারিয়াছিলেন। তাহার সময়ের শিক্ষিতেরা দেশকে ভুলিয়া বিদেশী ইতিহাসকে উপাড়িয়া এই দেশে আনিতে চাহিয়াছিলেন। র্তাহারা ভুলিয়াছিলেন ইতিহাসের রূপ দেশকে আশ্রয় করিয়া এক-এক স্থলে একএক ভাবে প্রকাশিত হয়। এইরূপ অনুসরণ করা যায় না। ইতিহাসের মধ্যে যে সত্য নিহিত আছে ওই সত্য সকল দেশেই এক। রাজনারায়ণবাবুর বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ অতি আশ্চর্যের বিষয়। তিনি ডিরোজিয়ের শিষ্য, ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত, ওই ভাষাতেই চিরদিন ভাব প্রকাশে অভ্যস্ত। অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যের সেবায় আত্মশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি যখন এই সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন, তখন এই সাহিত্যের শিশু অবস্থা। তখন ইহার মধ্যে আকর্ষণের কিছু ছিল না। তঁহাকে যদি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া জিজ্ঞাসা করা হইত— “এই ভাষায় কী আছে যে তুমি এই ভাষার সেবা করিবে?” উত্তরে তিনি কিছুই দেখাইতে পারিতেন না। কিন্তু তিনি তো আমনভাবে দেখেন নাই। এই শিশুর সূতিকাগৃহে যখন মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়াছিল। তিনি সেই ধ্বনির মধ্যে ভবিষ্যতের গৌরববাণী নিঃসন্দেহ শুনিয়াছিলেন, তিনি শিশুর মুখমণ্ডলে ভবিষ্যতের গৌরবচ্ছবি প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন; এইজন্যই তিনি বঙ্গসাহিত্যের সেই শিশুকালেই ইহাকে যে আসন প্ৰদান করিয়াছিলেন এখনো বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা সেই গৌরব দান করিতে চাহেন না। এইজন্য তিনি ওই সময়েই বঙ্গসাহিত্যের উন্নতি বিধান না করিলে বাঙালির উন্নতি হইতে পারে না ইহা সুস্পষ্ট বুঝিতেন। আমার তিনি বিশেষ উৎসাহদাতা ছিলেন। ১৮ বছরের সময় ইংলন্ড হইতে ফিরিয়া আমি ভারতীতে যাহা লিখিতাম, তাহা পাঠ করিয়া আমার লজ্জা হয়, তাহা এখনো ছাপার অক্ষরে আমার প্রতি চাহিয়া আমাকে লজ্জিত করে। রাজনারায়ণবাবু তাহা পরম আগ্রহে পড়িতেন, প্রত্যেকটি বাক্যের সমালোচনা করিয়া দেওঘর হইতে দীর্ঘ পত্র লিখিতেন। তঁহার সহৃদয়তাপূর্ণ পত্ৰ পাইবার জন্য আমি উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকিতাম। ছোটাে শিশুদের প্রতি রাজনারায়ণবাবুর অসীম শ্রদ্ধা ছিল। যাহারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তঁহারা অনেকে শিশুদের মধ্যে কেবল দোেষই দেখেন, তাহাদের উপর কেবল অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করেন। রাজনারায়ণবাবু যখন পঙ্ককেশ বৃদ্ধ, তখন আমায় বয়স ৮ বছর; ওই বয়সে তিনি আমার বয়স্য ছিলেন, আমার সহিত তাহার মেলামেশার কোনো বাধা ছিল না। র্তাহার এই শিশুগ্ৰীতির মূলে অসীম বিশ্বাস ছিল। শিশুদের মধ্যে যে মহৎ পরিণাম আছে তিনি তাহা ་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་ পারিতেন। জগতের একজন মহাপুরুষ বলিয়াছেন— ‘শিশুদের আমার নিকট ों\3 |” আমি যে এখন শিশু ও যুবকদিগকে ভালোবাসিতে পারি, ইহার মুলে দুই ব্যক্তি আছেন। প্রথম আমার পিতা। তিনি কোনোদিন আমাকে বালক বলিয়া অবজ্ঞা করেন নাই। তাহার সহিত আমার আলাপ-আলোচনা হাস্যপরিহাস সকলই চলিত। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। আমাকে সর্বপ্রকারে উৎসাহিত করিতেন। দ্বিতীয় রাজনারায়ণবাবু। তিনি আমার সহিত সমবয়সীর মতো মিশিতেন। আমাদের গৃহের দক্ষিণের কক্ষে দ্বিপ্রহর সময়ে তিনি শুইয়া থাকিতেন। তখন আমরা নিৰ্ভয়ে ওই কক্ষে কোলাহল করিতাম। হয়তো তাহার সম্বন্ধে কত কথা বলিতাম। তিনি সময়ে সময়ে