পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 98ܠܹ R শিশু মায়ের কোলে বাড়িতে থাকে। প্রত্যেক জাতি তেমনি আপনি আপন ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বাড়িয়া থাকে। এইরূপ বৃদ্ধি ও পরিণতির প্রয়ােজন আছে। এক সময়ে পৃথিবীর সকল জাতি এইরূপ বিচ্ছিন্নভাবে বাড়িয়াছে। কিন্তু এই বৃদ্ধিই চরম বৃদ্ধি নহে। সকল জাতিকেই বিশ্বের আপনারা শুনিয়াছেন যে ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের যুগে রামমোহন জন্মলাভ করেন। ওই বিপ্লবের যুগে যে বিশ্ববাণী ধ্বনিত হইতেছিল তাহা কেমন করিয়া শিশু রামমোহনের প্রাণ স্পর্শ করে আমরা তাহা বুঝিতে পারি না। উষার অরুণরশ্মি যেমন উচ্চ শিখরগুলিকে আলোকমণ্ডিত করে, তেমনি সেই যুগে পৃথিবীর কতিপয় মহাত্মা বিশ্ববোধের আলোক লাভ করিয়াছিলেন। শিখরে যখন প্রথম আলোকসম্পাত হয় তখন নিম্নভূমি গভীর অন্ধকারে আবৃত থাকে। বঙ্গভূমি যখন নানা কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন তখন বালক রামমোহন অলৌকিক রূপে বিশ্ববোধের আলোক লাভ করিয়াছিলেন। এই জ্ঞানলাভের পক্ষে দেশ অনুকুল ছিল না, বরং সমস্তই তাহার প্রতিকূলে ছিল। তিনি যেন দৈবশক্তিবলে এই জ্ঞান লাভ করিলেন। বঙ্গদেশের এক অখ্যাত অজ্ঞাত পল্লীগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া তিনি যে কেমন করিয়া বিশ্ববোধ লাভ করিলেন তাহা বিস্ময়কর। তিনিই এই দেশে তখন ভূমার বাণী ঘোষণা করিতেছিলেন। তিনি বলিয়াছেন বেদাহমেতং পুরুষং মহাস্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । সেই অন্ধকারের পরপরের মহান পুরুষকে তিনি জানিয়াছিলেন। অন্ধকারের পরপর হইতে জ্যোতির্ময় পুরুষের আলোক আসিয়া এই শিখরের উপর পতিত হইয়াছিল। পৃথিবীর কোনাে জাতি এখন আপনার সীমার মধ্যে বদ্ধ থাকিতে পরিবে না। উহাতে যে হীন দেশাত্মবােধ জগাইয়া থাকে তাহা হইতেই হানাহানি-মারামারির সৃষ্টি হয়। এখন প্রত্যেক দেশকে আপন গৃহবাতায়ন খুলিয়া দিয়া বিশ্বকে বরণ করিয়া লইতে হইবে। ছােটাে হইয়া থাকায় সুখ নাই, ভূমাতেই সুখ। ভূমৈব সুখম নায়ে সুখমস্তি। - পৃথিবীর কোনাে জাতি হীনতার মধ্যে চিরকাল থাকিবে না। বাঙালির নিরাশার কারণ নাই। বাঙালির গৃহে রামমোহন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বাঙালির ভবিষ্যৎ গীেরব প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। যাহারা মহৎ তাহারা অগীেরবের মধ্যে গৌরবকে, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎকে প্রত্যক্ষ করেন। এখন পৃথিবীতে যে রণকোলাহল চলিতেছে ইহারই মধ্যে প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা জাতিসমূহের ভবিষ্যৎ ভ্রাতৃসংঘের ছবি প্রত্যক্ষ করিতেছেন, তখন জাতিতে জাতিতে কীরূপ মৈত্রী স্থাপিত হইবে তাহার আলোচনা চলিতেছে। বঙ্গের ভবিষ্যৎ গৌরব তখনকার গভীর অন্ধকারের মধ্যেই রামমোহন প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তিনি বাঙালিকে বিশ্বের রাজপথ দেখাইয়া গিয়াছেন, বাঙালির কোনো নিরাশার কোনো আশঙ্কার কারণ নাই, বাঙালি বৃহৎ মনুষ্যত্বের পথে যাত্রা করিয়াছেন। “সঞ্জীবনী’ পত্রিকা কীর্তিক ১৩২৪