পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>Sb রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি ভাষার জন্য নিজেও যেটুকু চেষ্টা করেছি, তাও তাঁহারই কৃপায়। আমি যে আজ এসেছি তাহার কারণ, আমার সেই আস্তরিক শ্রদ্ধা আজ সকলের সম্মুখে জানালাম। আমি যে র্তাহার কাছে কত ঋণী তাহা স্বীকার করলাম। তিনি যে অস্ত্র ও উপকরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন তাহা বড়ো কম-জোর ছিল; তখনও ভাষায় শক্তিসঞ্চার হয় নাই। তিনি তখন সেই দুর্বল উপকরণ নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেইগুলিকে তিনি খুব বুঝে-সূজে প্রয়োগ করেছিলেন। পথ ও রথ হয়েছে। সাহিত্যের মধ্যাহ্নগগনে আজ তিনি থাকলে অসাধারণ প্ৰতিভা দ্বারা সকলকে লজ্জা দিতে পারতেন। কিন্তু সেই প্ৰভাতগগনে তিনি যে সাহিত্যের প্রাণ এনেছিলেন। প্ৰাণশক্তি বড়ো কম শক্তি নয়; তিনি ভাষাতে সেই শক্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। তখন ভাযায় ভাবের কাঠামোও ছিল এক, ধারাও ছিল এক-- যেমন নাটক লেখা হলে সব বিজয়-বসন্তে’র ছাদে... তিনি সেই ভাষায় সেই ভাবে বৈচিত্ৰ এনে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্ৰাণদানের সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈচিত্র্য নানা ভাবে ফুটে উঠেছিল। প্রাণসঞ্চারের পরেই নানা প্রকার রূপসৃষ্টি— আনন্দরূপ সৃষ্টি হয়। তিনি তখন ভাষার সেই প্ৰাণে সোনার কাঠি ছুইয়ে দিয়েছিলেন। আমরা যখন শুয়ে থাকি, ঘুমিয়ে পড়ি, তখন সবাই প্রায় এক- জাগলেই বৈচিত্র্যের প্রভেদ হয়। আমাদের ভাষায় প্রাণের নূতন জাগরণে পূর্বের একরকমের একঘেয়ের আর আবৃত্তি নাই। সকলেই সজাগ হয়ে ভাষা প্রয়োগ করতে পাচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্ৰই এই নূতন প্রাণের জাগরণ দিয়েছেন। প্ৰাণ ছােটাে হয়ে আসে, পরে বাড়ে। তখন এই প্ৰাণের এই জাগরণের আয়তনের- আকার ছোটাে ছিল, এখন সেই প্ৰাণবীজ বড়ো হয়ে উঠেছে। সেইজন্যই তাহার প্রতি আজ আমাদের এই নমস্কার-নিবেদন। ভাষায় প্ৰাণ সকলের চাইতে বড়ো, জাতির প্রাণ অপেক্ষা ভাষার প্রাণ বেশি বড়ো; কাজেই সেই প্ৰাণদানকারীকে আজ আমাদের সকলের নমস্কার। কার্য-বিবরণী পুস্তক বঙ্গীয় চতুর্দশ সাহিত্য-সম্মিলন : ৮ আষাঢ় ১৩৩০ • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ܔ বঙ্কিমের জন্য তোমরা যে শোক করছ, তার কি সবটা খাটো? তোমরা তার মহত্ত্বের কি টের পেয়েছি? হয়তো তার গভীর পুস্তকগুলি কিছুই পড় নি। কোনোটাই ভালো করে পড়েছ কি না। সন্দেহ। যে পরিপ্রেক্ষার (Perspective) মধ্যে তঁাকে বোঝা যেতে পারত। তা তো এখন দুর্লভ। তোমরা তাকে ঠিক করে বুঝবে কেমন করে? যদিও তখন আমরা অল্পবয়স্ক ছিলাম, তবু তীর মহত্ত্ব কতক পরিমাণে জানি আমরা। ভাষা কী ছিল, তার হাতে পড়ে কী হল? তীর বঙ্গদর্শনকে এখনকার মাপকাঠিতে দেখলে চলবে না। তখন তা এক অপরূপ সৃষ্টি। প্রতি মাসে এলে বাড়িতে কড়াকড়ি। গুরুজনদের কাছ থেকে আমরা পাই কেমন করে ? কী ভাষা নিয়ে বঙ্কিম আরম্ভ করলেন আর কী করে রেখে গেলেন? র্তার গুরু ঈশ্বর গুপ্তের ভাষা তো এ নয়। র্তার সময়কার রুচি ও দৃষ্টি তীর লেখার কোথাও ধরা পড়ে না। তিনি (Pioneer) যাত্রীদলের অগ্রদূত। নূতন পন্থা রচনায় সৃজনের দুঃসহ দুঃখ র্তার। তার দুঃখ তোমরা এখন বুঝবে কী করে? তখন বাংলা ছিল সংস্কৃতের দাসী। গরুড়ের মতো তিনি বিনতার দাস্য মােচন করলেন। দাসীবৃত্তি ছাড়লেও যে তার নিজস্ব ঐশ্বর্য তার অস্তরের মধ্যেই নিহিত আছে তা বঙ্কিম দেখিয়ে দিলেন।