পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ >○述 বাংলা ভাষাকে তিনি এমন করে রেখে গেলেন যে তা সর্বসাধনা ও ঐশ্বর্যের আধার হতে পারে। নিজে যে সব ঐশ্বৰ্য আহরণ করে তাতে রেখে দেখলেন যে বাংলা কী অপূর্ব আধার হয়েছে। তাই তো আমরা তাতে আমাদের যা-কিছু সাধনা তা রাখতে পেরেছি। বাংলা ভাষার উপর এই অটুট বিশ্বাস তীব্র ছিল। যাঁদের এই বিশ্বাস ছিল না। সেই সব ক্ষুদ্রপ্ৰাণ অবিশ্বাসীদের কাছে তিনি প্রকাশ্য গুপ্ত কত আঘাতই নিত্যনিরস্তর পেয়েছেন। ক্ষতবিক্ষত তঁাকে করেছে। কিন্তু বীরপুরুষ তিনি তা গ্রাহাই করেন নি। আজ আর নূতন করে কী বলব? তীর মৃত্যুর পরেই ১৮৯৪ সালের প্রথম স্মৃতি-সভায় । আমার সব কথা নিঃশেষে বলেছি। তখন অন্তর সদ্য আঘাতের ব্যথায় ভরা ছিল। এখন সেইসব কথা সহজে কি আর আসবে? খুব রাসভারি লোক ছিলেন তিনি। যাকে ইংরেজিতে cultural aristocracy বলে তা তীর ছিল। সেই স্তব্ধ মহান সাধক ছিলেন হিমালয়ের মহা শিখরের মতো নিঃসঙ্গ গম্ভীর। কেউ তার কাছে ঘেসতে পারতেন না। আমি তখন ছেলেমানুষ। অত বুঝতামও না, মানতামও না। আমি হামেশা তার কাছে গিয়েছি। পটলভাঙার কাছে তার বাড়িতে তিনি থাকতেন। চুচড়োয় থাকতেও তার বাড়িতে গিয়েছি। একেবারে নির্জন ছিল তার পরিবেশ। র্তার মধ্যে এমন কী একটা ছিল যে, কেউ তীর কাছে ঘেসতে সাহস করত না। তাতে হিংসা হয়। আমরা কখনো এই সৌভাগ্যের আস্বাদ জানি না। আহূত অনাহূত রবাহুত নানা রকমের লোকের নিত্য আনাগোনায় আমাদের সাহিত্য সাধনা ক্রমাগত ক্ষুন্ন হয়েছে। ছেলেমানুষ হলেও বঙ্কিম আমাকে যথেষ্ট প্রশ্ৰয় দিয়েছেন। তঁর কাছে যথেষ্ট প্রীতি ও স্নেহ পেয়েছি। র্তার দাদা সঞ্জীবচন্দ্র ছিলেন মজলিসী মানুষ। একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। মাটিতে তাকিয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে বিশাল দেহটি নিয়ে তিনি বিরাজ করতেন। আমাদের দেখলে আনন্দে হাস্যস্নেহে-আদরে সর্বভাবে স্বাগত করতেন। র্তারও প্রতিভা ছিল অসাধারণ। কিন্তু তীর মধ্যে গিমীপনা ছিল না বলে তিনি তীর শক্তির অনুরূপ সম্পদ রেখে যেতে পারেন নি। বঙ্কিম ছিলেন অন্যরূপ। তিনি ঋজু, অল্পবাক, দূরারাধ্য, শুদ্ধ সাধক। তিনি সাধকই বটে। র্তার সাধনালব্ধ যে চিন্ময় আধারটি তিনি দিয়ে গেলেন, তাহাই ক্রমে বাঙালির নব ইতিহাস সৃজনের মূল কাব্য হল। সেই দিক থেকে এই যোগ্যপাত্রে দেশ-বিদেশের কত ঐশ্বর্য যে সংগৃহীত ও সঞ্চিত হতে শুরু করেছে, তা আর শেষ করা যায় না। নানা দেশের ও কালের সম্পদ তাতে তিনি সঞ্চয় করে দেখালেন। ভরসা পেয়ে অন্যেরাও তাতে তাদের অর্ঘ্য রাখতে শুরু করেন। যে ভাষা অবজ্ঞার আবর্জনার আঁস্তাকুড় ছিল, তা হল শ্রদ্ধাবান যজমানের অর্ঘ্যের আধার পবিত্ৰ যজ্ঞভূমি। এত বড়ো দান আর নেই। আমরা নিজেরা সারা জীবনের সকল সঞ্চয় তাতে রাখতে পেরেছি বলে জানি কী অসামান্য অধিকার ও সম্পদ তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন। তঁর প্রসাদেই আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে সকল স্থান কাল হতে সকল সম্পদ আহরণ করে ও অস্তরের সব চিন্ময় ভাণ্ডার উজাড় করে তাতে রাখতে পেরেছি। র্তার যজ্ঞবেদীটি তিনি প্রজুলিত করে গেছেন। তঁর সমস্ত জীবনের চিন্ময় সম্পদ তাতে তিনি অর্ঘ্য দিয়ে গেছেন। বাংলা ভাষায় সেই যজ্ঞবেদিটিকে যদি তোমরা তোমাদের প্রত্যেকের সারাজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য দিয়ে পরিপূর্ণ করে রােখ, তবেই বঙ্কিমের যথার্থ শ্ৰাদ্ধ হবে। নহিলে স্মৃতি-সভার যত কিছু আয়ােজন ও সমারোহ সবই দুঃসহ বিড়ম্বনা। তাতে তীর শুদ্ধ বুদ্ধ আত্মা একটা কথা বলে শেষ করি। তীর “বন্দেমাতরম গানে আমিই প্রথমে সুর দিয়ে তীকে