পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>8良 রবীন্দ্র-রচনাবলী আত্মীয়ের হৃদয়ে তাহার জন্মগত অধিকারের আসনটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু মহান যে আত্মা, সে বিস্তৃত জীবনক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করে। বহুলোেক এবং বিভিন্ন জাতি সেই আত্মাকে স্বীকার করিয়া লয়। র্তাহার জন্মদিন অনুষ্ঠানে আমরা আজ তীহাকে আমাদের চিরকালের আপনি করিয়াই অনুভব করি না, তাহার মধ্য দিয়া অভুভব করি মানুষের ও জগতের সহিত আমাদের আত্মার আত্নীয়তা। আজ আমাদের মহৎ সৌভাগ্য এই যে, এইরকম একজন মানুষ আজ আমাদের মধ্যে আসিয়াছেন— আরও সৌভাগ্যের কথা এই যে, আমরা তঁহাকে অস্বীকার করি নাই! স্বাধীনতা এবং সত্যের অগ্রদূতগণকে আমরা প্রায়শই যেভাবে অস্বীকার করিয়াছি, তাহাকে সেরূপ করি নাই- এই আমাদের মহত্তর সৌভাগ্য। তঁহার প্রভাব ভারতের সর্বত্র- এমন-কি, ভারতের বাহিরেও মানুষকে প্রেরণা দিয়াছে। র্তাহার প্রেরণায় আমাদের মধ্যে সেই সত্য-বােধ জাগিয়াছে, সে সত্য আমাদের স্বার্থসংকীর্ণ বুদ্ধিকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। তঁহার জীবনই আমাদিগকে সেবা-মুক্তি এবং আত্মোৎসর্গের পথে অবিরাম আহবান করিতেছে। আজ জাতির পক্ষ হইতে মহাত্মজীকে মহৎ ভ্রাতা বলিয়া বরণ করিয়া লইবার দিন; কারণ বর্তমান যুগে আমাদের মাতৃভূমিতে তিনিই আমাদের সকলকে ভ্ৰাতৃত্ব বন্ধনে বঁধিয়াছেন। আমি আশা করি, আমরা সমস্ত অস্তরের সহিত গভীরভাবে আমাদের এই মনোভাব প্রকাশ করিব— শুধু আবেগময় অহংকারে মাতিয়া কখনো এই অনুষ্ঠানের তাৎপর্যকে লঘু করিয়া ফেলিব না। এই যুগের যে আহবান আমাদের নিকট আসিয়াছে, আমরা যেন তাহার যোগ্য হই এবং মহাত্মজীর নিকট হইতে আমরা সেই দায়িত্ব যেন গ্ৰহণ করি, যে দায়িত্ব তিনি নিজের জন্য গ্ৰহণ করিয়াছেন। আমরা জানি যে, সর্বমানবের হৃদয়ে সর্বদা বিরাজমান উপনিষদের দেবতাকে ‘মহাত্মা’ বলা হইয়াছে। আমরা আজ যে দেবমানবের সংবর্ধনা করিতেছি, তঁহাকে ওই আখ্যাটি ঠিকই দেওয়া হইয়াছে- কারণ র্তাহার মহান আত্মা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে। যাহারা ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এবং যাহারা পরে জন্মগ্রহণ করিবে সেই অগণিত জনগণের হািদয়ে তিনি বিরাজ করিতেছেন। র্তাহার আত্মার এই মহত্ত— অন্য সকলকে নিজের হৃদয়ে ধারণ করিবার এই ক্ষমতা আমাদের ইতিহাসে যাহা কখনো ঘটে নাই, তাহাই সম্ভব করিয়াছে, আজ জনসাধারণ পর্যন্ত এ কথা বুঝিতে পারিয়াছে যে, ভারতবর্ষ শুধু ভৌগোলিক অস্তিত্ব মাত্র নহে- ভারতবর্ষ একটি জীবন্ত সত্য, যে সত্যের মধ্যে তাহারা সর্বদা বাঁচিয়া আছে এবং সঞ্চরণ করিতেছে। দৈবায়ত্ত জন্মসূত্রে যাহারা ঘূণ্য বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে, যাহাদের নূক্ত পৃষ্ঠে শুধু অশ্রদ্ধারই বােঝা চাপানাে হইয়াছে, যে সহানুভূতি সমস্ত মানুষের জন্মগত অধিকার, সেই সহানুভূতি হইতে আমাদের দেশের যে বৃহৎ জনসংখ্যাকে ইচ্ছাপূর্বক বঞ্চিত রাখা হইয়াছে, তাহাদের প্রতি এই অনাচার বহু যুগ সঞ্চিত এই গুরুভার বােঝা, এই সহানুভূতি-বঞ্চনার পাপ দূর করিবার জন্য মহাত্মজী সংকল্প করিয়াছেন। তাঁহার এই মহৎ কার্যে যোগ দিবার জন্য আমাদের দৃঢ় চেষ্টা আমরা শুধু ভারতের নৈতিক দাসত্বের নিগড়কেই খসাইয়া ফেলিতেছি নাআমরা সমস্ত মনুষ্য জাতিকে পথপ্রদর্শন করিতেছি। অত্যাচার যেখানে, যে ভাবেই থাকুক-না- কেন, আমরা তাহাকে বিবেকের নিকট জবাব দিবার জন্য আহবান করিতেছি। বিবেকের এই নিষ্করুণ প্রশ্ন-জিজ্ঞাসাকেই মহাত্মজী আমাদের যুগের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। মহাত্মাজী যখন অনশন ব্রত আরম্ভ করিলেন, তখন আমাদের নিজের দেশে এবং বিদেশে বহু সন্দিগ্ধমনা ব্যক্তি র্তাহাকে উপহাস করিয়াছে, বিদ্রািপ করিয়াছে, কিন্তু তথাপি আমাদের চক্ষের সম্মুখেই অত্যাশ্চর্য যাহা, তাহা ঘটিয়া গেল। সনাতন সংস্কারের কঠিন পাষাণ বিচূর্ণ হইয়াছে। যে অর্থহীন বিধিনিষেধ আমাদের জাতীয় জীবনকে সংকুচিত করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা ইতিমধ্যেই খসিয়া পড়িতেছে। র্তাহার তপশ্চর্যার ফলে অদ্ভুত কাজ হইয়াছে, কিন্তু অস্পৃশ্যতার পাপ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না করা