পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS রবীন্দ্র-রচনাবলী কুমুদিনী। ঠাকুর! কোথায় আমায় আনলে! মোতির মার প্রবেশ মোতির মা। মন কেমন করছে ভাই! ওই-সব মেয়েদের কথায় কান দিয়ে না। প্রথম কিছুদিন তোমার উপর উপদ্রব চলবে, টেপাটেপি বলাবলি করবে, তার পরে কণ্ঠ থেকে ক্রমে ক্রমে বিষ নেমে গেলেই থেমে যাবে! বউরানী, আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। কিন্তু ছােটাে জা, সম্পর্কে ছোটাে। আমার কাছে মন খুলে কথা বােলো দিদি, নতুন চেনা বলে যেন বাধো-বাধো না করে। কুমুদিনী। তোমাকে মনে হয় না। নতুন চেনা। আপনাকে তোমার চিনিয়ে নিতে দেরি হয় না ভাই, তুমি সহজে ভালোবাসতে পাের, সে কথা গোড়া থেকেই বুঝেছি। মোতির মা। কী কথা ভাবিছ আমাকে বলে ভাই, তোমার মন খোলসা হয়ে যাক। কুমুদিনী। ক'দিন ধরে আমি ঠাকুরকে কেবলই বলেছি, আমি তোমাকে বড়ো বিশ্বাস করেছি, তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙো না। মোতির মা। বুঝতে পারি ভাই, তোমার কী যে হচ্ছে মনে। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তো ছিলুম কচি খুকি। মন তৈরিই হয় নি, মনের মধ্যে কিছুতেই কোনো খটকাই ছিল না। ছােটাে ছেলে কঁচা ফলটাকে যেমন টপ করে মুখে পুরে দেয়, স্বামীর সংসার তেমনি করেই আমাকে এক গ্রাসে গিলেছে, কোথাও কিছু বাধে নি। সবাই বললে ফুলশয্য, হয়ে গেল ফুলশয্য, সে একটা খেলা। কিন্তু তোমার এই ফুলশয্যে নিয়ে তোমার বুক যে কেঁপে উঠেছে, দোষ দেব কাকে! পর আপনি হতে সময় লাগে। সে সময় যে কেউ দিতে চায় না। টাকা পেতে বড়োঁঠাকুরের কত যুগ লেগেছে, আর মন পেতে তার যে দুদিন সবুর সইবে না। যেমনি হুকুম অমনি যােজর! কুমুদিনী। আমি তো মন দিতে সম্পূৰ্ণ তৈরি হয়েই এসেছিলাম। এদের ঘরে, কিন্তু সে মন কি এমনি করেই নিতে হয়- এত অশ্রদ্ধা ক'রে, ছিছি, এমন অপমান ক’রে! যে ভালোবাসা আমি ওঁকে দিতে এলুম, সে যে আমার ঠাকুরের প্রসাদ থেকে নেওয়া, বিয়ের আগে থেকেই পদে পদে তার অসম্মান ঘটেছে। এমন ব্যবহার যে কোথাও হতে পারে সে আমি মনে করতেও পারি নি, এ আমার একটুও জানা ছিল না, তাই আমি এত নিৰ্ভয়ে এত বিশ্বাস নিয়েই এসেছিলেম। মুখে কাপড় দিয়ে কান্না মোতির মা। কেন্দো না, দিদি, কেঁদো না। আজকের দিনে তোমার চোখের জল এখানকার গৃহলক্ষ্মী সইবেন না। কুমুদিনী। আজকে নিজের জন্যে আমার কান্না অন্যায় সে আমি জানি। আজকে সব কান্না আমার দাদার জন্যে। আজ তিনি রোগে বিছানায় পড়ে, সেই বিছানা থেকে তিনি আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। বুকের কাপড় থেকে টেলিগ্রাম বের করলে তিনি আশীৰ্বাদ করেছেন, “ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন।’ আজ সকাল থেকে সেই আশীর্বাদ আমি বুকে আঁকড়ে ধরে আছি- না, আজ আমি ভয় করব না, কোনো ভয় করব না। ঠাকুর, আজকের মতো আমাকে বল দাও। মোতির মা। একটা কথা মনে রেখে রানীদিদি, বড়োেঠাকুর তোমাকে ভালোবেসেছেন। ওঁর জীবনে এটা এমন অসম্ভব আশ্চর্য ঘটনা যে উনি ঠিকমতো করে তাকে মানিয়ে নিতে পারছেন না, তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে ওঁর ব্যাবসাদারের ভাষা। আজ তো বাড়ি ভরা মেয়ে- তবু কতবার কাজকর্ম ফেলে ঘুরে ফিরে বাড়ির মধ্যে এসেছেন, কোনো ছুতোয় একবার তোমাকে