পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SR 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মোতির মা। আমরাই তো খবর দিয়েছি তোমাকে। কুমুদিনী। আমি যদি খবর জানতে চাই তা হলে খবর দেওয়াটা অপরাধ ? নবীন। কর্তাকে না জানিয়ে দেওয়াটা অপরাধ। কুমুদিনী। তাই ভালো। অপরাধ তোমরাও করেছ, আমিও করেছি। একসঙ্গেই ফলভোগ করব। ঠাকুরপো, দ্বিধা কোরো না, আমারও যাবার আয়োজন করো। নবীন। আচ্ছা, দেখি ব’লে, দাদা কী বলেন। [প্ৰস্থান মোতির মা। দিদি, এটা একটা ভুল হবে না তো? কুমুদিনী। কোনটা? মোতির মা। এই ছেড়ে চলে যাওয়া? কুমুদিনী। তাড়িয়েই যদি দেয় তো কী করব? মোতির মা। কিন্তু দিদি কুমুদিনী। না ভাই, এর মধ্যে আর কিন্তু নেই। এ শাস্তি আমাকেই দেওয়া হয়েছে। আমি যাদের স্নেহ করি একে একে তাদের সরিয়ে দিয়ে ভেবেছেন আমাকে পাবেন সম্পূর্ণ করে। কিন্তু তাই কি কখনো হয়? একটা জিনিসকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেললে পাবার মতো তাতে বাকি থাকে কী? আমার দূর্ভাগ্য! দেবার মতো করে যখনি থালা সাজিয়ে নৈবেদ্য গড়ে তুলেছি তখনি কে যেন ধাক্কা দিয়ে আমার নৈবেদ্য ছারখার করে দিচ্ছে! মোতির মা। কিন্তু আমরা যে গরিব দিদি। কুমুদিনী। আমিও কম গরিব না। আমারও বেশ চলে যাবে। আজ আমার কী মনে হচ্ছে জান ? এই-যে আমার হঠাৎ বিয়ে হল, এ তো সমস্ত আমি নিজে ঘটিয়ে তুললুম। কিন্তু কী অদ্ভুত মোহে, কী ছেলেমানুষি করে! যা-কিছুতে সেদিন আমাকে ভুলিয়েছিল তার মধ্যে সমস্তই ছিল ফাঁকি। অথচ এমন দৃঢ় বিশ্বাস, এমন বিষম জেদ, যে, সেদিন আমাকে কিছুতেই কেউ ঠেকাতে পারত না। দাদা বাধা দেন নি বটে, কিন্তু কত ভয় পেয়েছেন, কত উদবিগ্ন হয়েছেন, তা কি আমি বুঝতে পারি নি! বুঝতে পেরেও নিজের ঝোকটাকে একটুও দমন করি নি। মোতির মা। আচ্ছা দিদি, তুমি যে বিয়ে করতে মনস্থির করলে, কী ভেবে? কুমুদিনী। তখন মনে একটুও সন্দেহ ছিল না যে প্রজাপতি যাকেই স্বামী বলে ঠিক করে দিয়েছেন তাকেই ভালোবাসবই। ছেলেবেলা থেকে কেবল মাকে দেখেছি, পুরাণ পড়েছি, কথকতা শুনেছি, মনে হয়েছে শাস্ত্রের শ্লোকের সঙ্গে নিজের জীবনকে গেথে দেওয়া খুব সহজ। মোতির মা। দিদি, উনিশ বছরের কুমারীর জন্যে শাস্ত্ৰ লেখা হয় নি। কুমুদিনী। আজ বুঝতে পেরেছি। সংসারে ভালোবাসাটা উপরি পাওনা। ওটাকে বাদ দিয়েই ধর্মকে আঁকড়ে ধরে সংসার-সমুদ্রে ভাসতে হয়। ধর্ম যদি সরস হয়ে ফুল না দেয়, ফল না দেয়, অস্তত শুকনো হয়ে যেন ভাসিয়ে রাখে। মধুসূদনের প্রবেশ। মেতির মার প্রস্থান মধুসূদন। বড়োবাউ, তুমি যেতে পারবে না। কুমুদিনী। কেন? মধুসূদন। হাঁ, আমার হুকুম। কুমুদিনী। বেশ, তা হলে যাব না। তার পরে, আর কী হুকুম আছে বলো মধুসূদন। না, আর কিছু নেই। শোনো, শোনো, তোমার জন্যে আংটি এনেছি।