পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&8t রবীন্দ্র-রচনাবলী পরে ভাগ্যের এই বিচার। একটা রূঢ় কথা ওর মুখ দিয়ে বেরচ্ছিল, এমন সময় | বাঁশরি } অলক্ষ্য পথ দিয়ে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালে। ওকে দেখেই সোেমশংকর চমকে দাঁড়িয়ে উঠল, লাল হয়ে উঠল তার মুখ। বাঁশরি বললে, “শংকর, আজ আমার এখানে নেমস্তন্ন ছিল না। ধরে নিচ্ছি সেটা আমার গ্রহের ভুল নয়, গৃহকর্তাদেরই ভুল, সংশোধন করবার জন্যে এলুম। সুষমার সঙ্গে আজ তোমার এনগেজমেন্টের দিন, অথচ এ সভায় আমি নেই। এ কখনো হতেই পারে না। খুশি হও-নি। অনাহূত এসেছি বলে।” “খুব খুশি হয়েছি সে কি বলতে হবে।” “সে কথাটা ভালো ক'রে বলবার জন্যে চলে ওই ফোয়ারার ধারে ময়ূরের ঘরের কাছে। পৃথীশবাবু নিশ্চয়ই প্লটের জন্য একমনে ছিপ ফেলে বসে আছেন, ওঁর ওই অবকাশটা নষ্ট করলে বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি হবে। দেখছি না। সর্বসাধারণ থেকে অসীম দূরে এক কোণে আছেন বসে।” সোেমশংকরের হাতে হাত বুলিয়ে বাঁশরি চলে গেল ময়ূরের ঘরের দিকে। পুকুরের মাঝখানে ফোয়ারা। ঘাটের পাশে চাপা গছ। গাছের তলায় ঘাসের উপর বসল দুজনে। সোেমশংকর সংকোচ বােধ করলে, সবাই তাদের দূর থেকে দেখছে। কিন্তু বাঁশরির ইঙ্গিত অবহেলা করবার শক্তি নেই তার রক্তে। পুলক লাগল ওর দেহে। বাঁশরি বললে, “সময় বেশি নেই, কাজের কথাটা এখনি সেরে ছুটি দেব। তোমার নতুন এনগেজমেন্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জল জমেছে, সেগুলো সাফ করে ফেললে পথটা পরিষ্কার হবে। এই নাও।” এই বলে একটা পান্নার কণ্ঠী, হীরের ব্রেসলেট, একটা মুক্তো বসানো বড়ো গোল ব্রোচ ফুলকাটা রেশমের থলি থেকে বের করে সোেমশংকরকে দেখিয়ে আবার থলিতে ভরে তার কোলের উপর ফেলে দিলে। থলিটা বঁশিরির নিজের হাতের কাজ করা। সোেমশংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “বাঁশি, জানো আমার মুখে কথা জোগায় না। যতটুকু বলতে পারলেম না তার সব মানে নিজে বুঝে নিয়ো৷” বাঁশরি দাঁড়িয়ে উঠল। বললে, “সব কথাই আমার জানা, মানে আমি বুছি। এখন যাও, তোমাদের সময় হল।” “যেয়ে না। বঁশি, ভুল বুঝে না। আমাকে। আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। আমি জঙ্গলের মানুষ শহরে এসে কলেজে পড়া আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা। সে দৈবের খেলা। তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে। তার দাম কিছুতে শোধ হবে না। তুচ্ছ এই গয়নাগুলো।” “আমার শেষ কথাটা শোনো শংকর। আমার তখন প্রথম বয়েস, তুমি এসে পড়লে সেই নতুন-জাগা অরুণ রঙের মধ্যে, ডাক দিয়ে বাইরে আনলে যাকে তাকে নাও বা না নাও, নিজে তো তাকে পেলুম। আত্মপরিচয় ঘটল, বাস। দুই পক্ষের হয়ে গেল শোধবোধ। এখন দুইজনে অঋণী হয়ে আপন-আপনি পথে চললুম, আর কী চাই।” সোেমশংকর থলিটা পকেটের মধ্যে পুরে গয়নাগুলো ফেলে দিলে পুকুরে। বাঁশরি দ্রুতপদে চলে গেল যেখানে বসে আছে পৃথীশ। সকলেরই লক্ষ্যগোচর ভাবে বসল। তার পাশে। প্রশ্ৰয় পেয়ে পৃথীশ একটু ঝগড়ার সুরে বললে, “এত দেরি করে এলে যে।” “প্ৰমাণ করবার জন্যে যে বাঘ-ভালুকের মধ্যে আসে নি। সবাই বলে উপন্যাসের নতুন পথ খুলেছি নিজের জোরে, আর এখানকার এই পুতুল নাচের মেলার পথটা বের করতে ওফিস্যাল গাইড চাই, লোকে যে হাসবে” । r “পথ না পাই তো অন্তত গাইডকে তো পাওয়া গেল।” এই বলে একটু ভাবের ঝোঁক দিয়ে ওর দিকে তাকালে। এই রকম আবিষ্ট অবস্থায় পৃথীশের মুখের ভঙ্গি বাঁশরি সইতে পারত না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, “সস্তা মিষ্টান্নের কারবার শুরু করতে আজ ডাকি নি তোমাকে। সত্যি করে দেখতে শেখে, তার পরে সত্যি করে লিখতে শিখতে পারবে। অনেক মানুষ অনেক