পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ললাটের লিখন 令á汉 শুনলুম ভালো হল আমার, শ্ৰদ্ধা গেল ভেঙে; বন্ধন গেল ছিড়ে। শিশুকে মানুষ করার কাজ আমার নয়, সে কাজের ভর সম্পূর্ণ দিলুম এই মেয়েকে।” এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল মুক্তারাম। পদধূলি নিয়ে তাকে প্ৰণাম করলে সোেমশংকর। অগ্নিশিখার মতো বাঁশরি দাঁড়াল তার সামনে। বললে, “আজ রাগ করবেন না, ধৈর্য ধরবেন, কিছু বলব, কিছু প্রশ্ন করব।” “আচ্ছ বলো তুমি৷”-- মুক্তারামের ইঙ্গিতে সোেমশংকর চলে গেল। “জিজ্ঞাসা করি, সোমশংকরকে শ্ৰদ্ধা করেন। আপনি।” “বিশেষ শ্ৰদ্ধা করি।” “তবে কেন এমন মেয়ের ভার দিচ্ছেন ওর কাধে যে ওকে ভালোবাসে না।” “যে ভার দিয়েছি আমি তাকেই বলি মহাদ্রভাব। বলি পুরস্কার। একমাত্র সোেমশংকর সুষমাকে গ্রহণ করবার যোগ্য।” “ওর চিরজীবনের সুখ নষ্ট করতে চান। আপনি?” ‘সুখকে উপেক্ষা করতে পারে ওই বীর মনের আনন্দে।” “আপনি মানবপ্রকৃতিকে মানেন না?” “মানবপ্রকৃতিকেই মানি, তার চেয়ে নীচের প্রকৃতিকে নয়।” “এতই যদি হল- বিবাহ ওরা নাই করত।” ‘ব্রতের সঙ্গে ব্ৰতকে প্ৰাণের বন্ধনে যুক্ত করতে চেয়েছিলুম। খুঁজেছিলুম তেমন দুটি মানুষকে, দৈবাৎ পেয়েছি। এটা একটা সৃষ্টি হল।" আর কেউ হলে বাঁশরি জিজ্ঞাসা করত— "আপনি নিজেই করলেন না কেন?” কিন্তু মুক্তারামের চােখের সামনে এ প্রশ্ন বেধে গেল। বললে, “পুরুষ বলেই বুঝতে পারছেন না, ভালোবাসা। নইলে দুজন মানুষকে সম্পূর্ণ করে 060 “মেয়ে বলেই বুঝতে চাইছ না যে, প্রেমের মিলন ভালোবাসার চেয়ে সত্য, তাতে মোহের মিশেল নেই।” ‘সন্ন্যাসী, তুমি জান না মানুষকে। তার হৃদয়গ্ৰন্থি জোর করে টেনে ছিড়ে সেই জায়গায় তোমার নিজের আইডিয়ার গ্রন্থি জুড়ে দিয়ে অসহ্য ব্যথার পরে বড়ো বড়ো বিশেষণ চাপা দিতে চাও। গ্রন্থি টিকবে না। ব্যথাই যাবে থেকে। মানুষের লোকালয়ে তোমরা এলে কী করতে— যাও-না তোমাদের গুহার গহবরে বদরিকাশ্ৰমে- সেখানে মনের সাধে নিজেদের শুকিয়ে মারতে চাও মারো, আমরা সামান্য মানুষ আমাদের তৃষ্ণার জল মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সাধনা বলে প্রচার করতে এলে কোন করুণায়? আমাদের অভিশাপ লাগবে না তোমাকে? যা তুমি নিজে ভোগ করতে জান না তা তুমি ভোগ করতে দেবে না ক্ষুধিতকে? “এই যে সুষমা, শোনো বলি, মেয়েরা চিতার আগুনে মরেছে অনেকে, ভেবেছে তাতেই পরমার্থ। তেমনি করে দিনে দিনে মরতে চাও জুলে- চাও না তুমি ভালোবাসা। কিন্তু যে চায়, পাষাণ করে নি যে আপন নারীর প্রাণ, কেন কেড়ে নিতে এলে তার চিরজীবনের সুখ। এই আমি আজ বলে দিলুম তোমাকে, ঘোড়ায় চড়ো, শিকার করে যাই করা, তুমি পুরুষ নও, আইডিয়ার সঙ্গে গাঁঠিছড়া বেঁধে তোমার দিন কাটবে না গো, তোমার রাত বিছিয়ে দেবে কঁটার শয়ন।” বঁশিরির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে বাইরে থেকে তাড়াতাড়ি এল সোেমশংকর। বললে, “বাঁশি, শান্ত হও, চালো এখান থেকে।” “যাব না তো কী। মনে কোরো না বৃক ফেটে মরব, জীবন হয়ে থাকবে চির-চিন্তানলের শ্মশান। কখনো আমার এমন বিচলিত দশা হয় নি- আজকেন বন্যার মতো এল এই পাগলামি!