পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@ O রবীন্দ্র-রচনাবলী সতীশচন্দ্র রায় জীবনে যে ভাগ্যবান পুরুষ সফলতা লাভ করিতে পারিয়াছে, মৃত্যুতে তাহার পরিচয় উজ্জ্বলতর হইয়া উঠে। তাহাকে যেমন হারাই, তেমনি লাভও করি। মৃত্যু তাহার চারি দিকে যে অবকাশ সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু যে জীবন দৈবশক্তি লইয়া পৃথিবীতে আসিয়াছিল, অথচ অমরতলাভের পূর্বেই মৃত্যু যাহাকে অকলে আক্রমণ করিয়াছে, সে আপনার পরিচয় আপনি রাখিয়া যাইতে পারিল না। যাহারা তাহাকে চিনিয়াছিল, তাহার বর্তমান অসম্পূর্ণ আরম্ভের মধ্যে ভাবী সফল পরিণাম পাঠ করিতে পারিয়াছিল, যাহারা তাহার বিকাশের জন্য অপেক্ষা করিয়াছিল, তাহাদের বিচ্ছেদবেদনার মধ্যে একটি বেদনা এই যে, আমার শোককে সকলের সামগ্ৰী করিতে পারিলাম না। মৃত্যু কেবল ক্ষতিই রাখিয়া গেল। সতীশচন্দ্ৰ সাধারণের কাছে পরিচিত নহে। সে তাহার যে অল্প কয়টি লেখা রাখিয়া গেছে, তাহার মধ্যে প্রতিভার প্রমাণ এমন নিঃসংশয় হইয়া উঠে নাই যে, অসংকোচে তাহা পাঠকদের কৌতুহলী দৃষ্টির সম্মুখে আত্মমহিমা প্রকাশ করিতে পারে। কেহ বা তাহার মধ্যে গৌরবের আভাস দেখিতেও পারেন, কেহ বা না-ও দেখিতে পারেন, তাহা লইয়া জোর করিয়া আজ কিছু বলিবার পথ নাই। কিন্তু লেখার সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যক্তি লেখকটিকেও কাছে দেখিবার উপযুক্ত সুযোগ পাইয়াছে, সে ব্যক্তি কখনো সন্দেহমাত্র করিতে পারে না যে, সতীশ বঙ্গসাহিত্যে যে প্রদীপটি জ্বালাইয়া যাইতে পারিল না, তাহা জুলিলে নিভিত না। আপনার দেয় সে দিয়া যাইতে সময় পায় নাই, তাহার প্রাপ্য তাহাকে এখন কে দিবো? কিন্তু আমার কাছে সে যখন আপনার পরিচয় দিয়া গেছে, তখন তাহার অকৃতাৰ্থ মহত্ত্বের উদ্দেশে সকলের সমক্ষে শোকসস্তপ্তচিত্তে আমার শ্রদ্ধার সাক্ষ্য না দিয়া আমি থাকিতে পারিলাম না। তাহার অনুপম হৃদয়মাধুর্য, তাহার অকৃত্ৰিম কল্পনাশক্তির মহার্যতা, জগতে কেবল আমার একলার মুখের কথার উপরই আত্ম-প্রমাণের ভার দিয়া গেল, এ আক্ষেপ আমার কিছুতেই দূর হইবে না। তাহার চরিত্রের মহত্ত্ব, কেবল আমারই স্মৃতির সামগ্ৰী করিয়া রাখিব, সকলকে তাহার ভাগ দিতে পারিব না, ইহা আমার পক্ষে দুঃসহ। সতীশ যখন প্রথম আমার কাছে আসিয়াছিল, সে অধিক দিনের কথা নহে। তখন সে কিশোরবয়স্ক, কলেজে পড়িতেছে- সংকোচে সম্রামে বিনম্রমুখে অল্পই কথা। কিছুদিন আলাপ করিয়া দেখিলাম, সাহিত্যের হাওয়াতে পক্ষাবিস্তার করিয়া দিয়া সতীশের মন একেবারে উধাও হইয়া উড়িয়াছে। এ বয়সে অনেক লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হইয়াছে, কিন্তু এমন সহজ অন্তরঙ্গতার সহিত সাহিত্যের মধ্যে আপনার সমস্ত অস্তঃকরণকে প্রেরণ করিবার ক্ষমতা আমি অন্যত্র দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সাহিত্যের মধ্যে ব্রাউনিং তখন সতীশকে বিশেষভাবে আবিষ্ট করিয়া ধরিয়াছিল। খেলাচ্ছলে ব্রাউনিং পড়বার জো নাই। যে লোক ব্রাউনিংকে লইয়া ব্যাপৃত থাকে, সে হয় ফ্যাশানের খাতিরে, নয়, সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ্যবশতই এ কাজ করে। আমাদের দেশে ব্রাউনিংয়ের ফ্যাশান বা ব্রাউনিংয়ের দল প্রবর্তিত হয় নাই, সুতরাং ব্রাউনিং পড়িতে যে অনুরাগের বল আবশ্যক হয় তাহা বালক সতীশেরও প্রচুর পরিমাণে ছিল। বস্তুত সতীশ সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ ও সঞ্চরণ করিবার স্বাভাবিক অধিকার লইয়া আসিয়াছিল। যে সময়ে সতীশের সহিত আমার আলাপের সূত্রপাত হইয়াছিল, সেই সময়ে বােলপুর স্টেশনে আমার পিতৃদেবের স্থাপিত “শান্তিনিকেতন’ নামক আশ্রমে আমি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা