পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ Ve( কেন্দ্ৰনিহিত ছিল, এইজন্য তঁহার সমস্ত জীবনের বিকাশই এই প্রার্থনার ব্যাখ্যা। জাগ্ৰত আত্মার এই স্বভাবের গতিটিই সকল ধর্ম-সমাজের প্রধান শিক্ষার বিষয়। সাধকের মধ্যে ইহারই রূপটি ইহারই বেগটি যদি দেখিতে পাই। তবেই সে আমাদের পরম লাভ হয়। মতের ব্যাখ্যা এবং উপদেশকে যদি বা পথ বলা যায় কিন্তু দৃষ্টি বলা যায় না। বাঁধা পথ না থাকিলেও দৃষ্টি আপন পথ খুজিয়া বাহির করে। এমনকি, পথ অত্যন্ত বেশি বাঁধা হইলেই মানুষের দৃষ্টির জড়তা ঘটে, মানুষ চোখ বুজিয়া চলিতে থাকে, অথবা চিরদিন অন্যের হাত ধরিয়া চলিতে চায়। কিন্তু প্ৰাণক্রিয়া প্ৰাণের মধ্য দিয়াই সঞ্চারিত হয়। আত্মার প্রাণশক্তি সহজ প্রাণশক্তির দ্বারাই উদবােধিত হয়। কেবল বাহিরের পথ বাঁধায় নহে, সেই অস্তরের উদবােধনে যাহারা ব্ৰাহ্মসমাজকে সাহায্য করিয়াছেন শিবনাথ তঁহাদের মধ্যে একজন অগ্রগণা ব্যক্তি। শিবনাথের প্রকৃতির একটি লক্ষণ বিশেষ করিয়া চােখে পড়ে; সেটি তাহার প্রবল খুব বড়ো শক্তি। যাহারা শুদ্ধভাবে সংকীর্ণভাবে কর্তব্যনীতির চর্চা করেন তাহারা এই শক্তিকে হারাইয়া ফেলেন। কিন্তু শিবনাথের সহৃদয়তা এবং কল্পনাদীপ্ত অস্তদৃষ্টি দুই-ই ছিল এইজন্য মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়া দেখিতে পারিতেন, তাহাকে সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো বাজারদরের কষ্টিপাথরে ঘষিয়া যাচাই করিতেন না। তঁহার আত্মজীবনী পড়িতে পড়িতে এই কথাটিই বিশেষ কবিয়া মনে হয়। তিনি ছোটাে ও বড়ো, নিজের সমাজের ও অন্য সমাজের নানাবিধ মানুষের প্রতি এমন একটি ঔৎসুক প্রকাশ কবিয়াছেন যাহা হইতে বুঝা যায় তাহার হৃদয় প্রচুর হাসিকান্নায় সামগ্ৰী ছিল না। তিনি অজস্র গল্পের ভাণ্ডার ছিলেন- মানববাৎসল্য হইতেই এই গল্প তার মনে কেবলই জমিয়া উঠিয়াছিল। মানুষের সঙ্গে যেখানে তঁর মিলন হইয়াছে সেখানে তার নানা ছোটােবড়ো কথা নানা ছোটােবড়ো ঘটনা। আপনি আকৃষ্ট হইয়া তাহার হৃদয়ের জালে ধরা পড়িয়াছে এবং চিরদিনের মতো তার মনের মধ্যে তাহা থাকিয়া গেছে। অথচ এই তার মানববাৎসলা প্ৰবল থাকা সত্তেও সত্যের অনুরোধে তীহাকেই পদে পদে ও প্রতি তাহার বিশেষ প্রবল ছিল তাহদের বিরুদ্ধে বার বাবা তাহকে কঠোর সংগ্ৰাম কবিতে হইয়াছে। মানুষের প্রতি তাহার ভালোবাসা সত্যের প্রতি তাঁহার নিষ্ঠাকে কিছুমাত্র দুর্বল করিত্রে পারে নাই। যে ভূমিতে তিনি জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা মানব-প্রেমের রসে কোমল ও শ্যামল, আর যে আকাশে তিনি তাহাকে বিস্তীৰ্ণ করিয়াছিলেন তাহা সত্যের জ্যোতিতে দীপ্যমান ও কল্যাণের শক্তিপ্রবাহে সমীবিত । প্রবাসী अशश. १७९७ বিদ্যাসাগর আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্মরণ-সভা বছর বছর হয়। কিন্তু তাতে বক্তারা মন খুলে সব কথা বলেন না, এই ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশের লোকেরা একদিক দিয়ে তঁাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে থাকতে পারেন নি বটে কিন্তু বিদ্যাসাগর তীর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নিৰ্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবলমাত্র তীরে দয়াদাক্ষিণের খ্যাতির দ্বারা তারা ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের বেয়ে বড়ো পরিচয় সেইটিই তার দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছেন।