পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ Aይ°ላ সেইজন্যেই আশ্চর্যের কথা এই যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও, এই দেশেরই একজন এই নবীনের বিদ্রোহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি আপনার মধ্যে সত্যের তেজ, কর্তবোৰ সাহস অনুভব করে ধর্মবৃদ্ধিকে জয়ী করবার জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানেই তার যথার্থ মহন্তু। সেদিন সমস্ত সমাজ এই ব্ৰাহ্মণ-তনয়কে কীরূপে আঘাত ও অপমান করেছিল, তার ইতিহাস আজকার দিনে স্নান হয়ে গেছে, কিন্তু যাঁরা সেই সময়ের কথা জানেন তঁরা জানেন যে তিনি কত বড়ো সংগ্রামের মধ্যে একাকী সত্যের জোরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিন জয়ী হয়েছিলেন বলে গৌরব করতে পারি নে। কারণ সত্যের জয়ে দুই প্রতিকূল পক্ষেরই যোগ্যতা থাকা দরকার। কিন্তু ধর্মযুদ্ধে যারা বাহিরে পরাভব পান তারাও অস্তরে জয়ী হন, এই কথাটি জেনে আজ আমরা তার জয়কীর্তন করব। বিদ্যাসাগর আচারের দুর্গকে আক্রমণ করেছিলেন, এই তাঁর আধুনিকতার একমাত্র পরিচয় নয়। যেখানে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচা বিদার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন সেখানেও উদ্ভাব বুদ্ধির ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেন নি। তিনি জানতেন, বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগবিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্ৰে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। অথচ তিনিই বর্তমান যুরোপীয় বিদার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদযোগী হয়েছিলেন এবং নিজের উৎসাহ ও চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন। এই বিদ্যাসম্মিলনের ভার নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তি যার বাইরের ব্যবহার বেশভূষা ত্যাতিথ্যো বরণ কবতে পেরেছিলেন এইটেই বড়ো রমণীয় হয়েছিল। তিনি অনেক বেশি বয়সে বিদেশী বিদ্যায় প্রবেশলাভ করেন এবং তার গৃহে বাল্যকালে ও পুরুষানুক্রমে সংস্কৃত-বিদ্যারই চর্চা হয়েছে। অথচ তিনি কোনো বিরুদ্ধ মনোভাব না নিয়ে অতি প্ৰসন্নচিত্তে পাশ্চাত্য বিদ্যাকে গ্ৰহণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই আধুনিকতার গীেরবকে স্বীকার করতে হবে। তিনি নবীন ছিলেন এবং চির-যৌবনের অভিষেক লাভ করে বলশালী হয়েছিলেন। তার এই নবীনতাই আমার কাছে সব চেয়ে পূজনীয় কারণ তিনি আমাদের দেশে চলাবার পথ প্রস্তুত করে গেছেন! প্রতোক দেশের মহাপুরুষদের কাজই হচ্ছে এইভাবে বাধা অপসারিত করে ভাবী যুগে যাত্রা করবার পথকে মুক্ত করে দেওয়া। তারা মানুষের সঙ্গে মানুষের, অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের সত্য সম্বন্ধের বাধা মোচন করে দেন। কিন্তু বাধাই যে-দেশের দেবতা সে দেশ এই মহাপুরুষদের সম্মান করতে জানে না। বিদ্যাসাগরের পক্ষে এই প্রত্যাখ্যানই তার চরিত্রের সব চেয়ে বড়ো পরিচয় হয়ে থাকবে। এই ব্রাহ্মণতনয় যদি তেঁর মানসিক শক্তি নিয়ে কেবলমাত্র দেশের মনোরঞ্জন করতেন, তা হলে অনায়াসে আজ তিনি অবতারের পদ পেয়ে বসতেন এবং যে নৈরাশোর আঘাত তিনি পেয়েছিলেন তা তাকে সহ্য করতে হত না। কিন্তু যাঁরা বড়ো, জনসাধারণের চাটুবৃত্তি করবার জন্যে সংসারে তাদের জন্ম নয়। এইজনো জনসাধারণও সকল সময় স্তুতিবাক্যের মজুরি দিয়ে তাদের বিদায় করে না। এ কথা মানতেই হবে যে বিদ্যাসাগর দুঃসহ আঘাত পেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই বেদনা বহন করেছিলেন। তিনি নৈরাশ্যগ্রস্ত pessimisা ছিলেন বলে আখ্যাতি লাভ করেছেন, তার কারণ হচ্ছে যে যেখানে তার বেদনা ছিল দেশের কাছ থেকে সেখানে তিনি শান্তি পান নি। তিনি যদিও তাতে কর্তব্যভ্রষ্ট হন নি, তবুও তার জীবন যে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়েছিল তা অনেকের কাছে অবিদিত নেই। তিনি তার বড়ো তপস্যার দিকে স্বদেশীয়ের কাছে অভ্যর্থনা পান নি, কিন্তু সকল মহাপুরুষেরাই এই না-পাওয়ার গৌরবের দ্বারাই ভূষিত হন। বিধাতা তাদের যে দুঃসাধ্য সাধন করতে সংসারে পাঠান, তারা সেই দেবদত্ত দেীতোর দ্বারাই অস্তরের মধ্যে সম্মান