পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૨૧ শশিভূষণের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল। আইন অত্যন্ত মন্দগতি— সে একটা বৃহৎ জটিল লৌহযন্ত্রের মতো ; তৌল করিয়া সে প্রমাণ গ্রহণ করে এবং নিবিকার ভাবে সে শাস্তি বিভাগ করিয়া দেয়, তাহার মধ্যে মানবহদয়ের উত্তাপ নাই। কিন্তু ক্ষুধার সহিত ভোজন, ইচ্ছার সহিত উপভোগ ও রোষের সহিত শাস্তিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া শশিভূষণের নিকট সমান অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইল। অনেক অপরাধ আছে যাহা প্রত্যক্ষ করিবামাত্র তৎক্ষণাৎ নিজ হস্তে তাহার শাস্তিবিধান না করিলে অন্তর্যামী বিধাতাপুরুষ যেন অস্তরের মধ্যে থাকিয়া প্রত্যক্ষকারীকে দগ্ধ করিতে থাকেন। তখন আইনের কথা স্মরণ করিয়া সাস্তুনা লাভ করিতে হৃদয় লজ্জা বোধ করে। কিন্তু কলের আইন এবং কলের জাহাজ ম্যানেজারটিকে শশিভূষণের নিকট হইতে দূরে লইয়া গেল। তাহাতে জগতের আর আর কী উপকার হইয়াছিল বলিতে পারি না কিন্তু সে যাত্রায় নিঃসন্দেহ শশিভূষণের ভারতবর্ষীয় প্লীহা রক্ষা পাইয়াছিল । মাঝিমাল্লা যাহারা বাচিল তাহাদিগকে লইয়া শশী গ্রামে ফিরিয়া আসিলেন । নৌকায় পাট বোঝাই ছিল, সেই পাট উদ্ধারের জন্য লোক নিযুক্ত করিয়া দিলেন এবং মাঝিকে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে পুলিসে দরখাস্ত দিতে অনুরোধ করিলেন । মাঝি কিছুতেই সন্মত হয় না । সে বলিল, নৌকা তো মজিয়াছে, এক্ষণে নিজেকে মজাইতে পারিব না। প্রথমত, পুলিসকে দর্শনি দিতে হইবে ; তাহার পর কাজকর্ম আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়া আদালতে আদালতে ঘুরিতে হইবে ; তাহার পর সাহেবের নামে নালিশ করিয়া কী বিপাকে পড়িতে হইবে ও কী ফল লাভ হইবে তাহা ভগবান জানেন। অবশেষে সে যখন জানিল, শশিভূষণ নিজে উকিল, আদালতখরচ তিনিই বহন করিবেন এবং মকদ্দমায় ভবিষ্যতে খেসারত পাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে তখন রাজি হইল। কিন্তু শশিভূষণের গ্রামের লোক যাহারা ষ্টিমারে উপস্থিত ছিল তাহারা কিছুতেই সাক্ষ্য দিতে চাহিল না। তাহারা শশিভূষণকে কহিল, “মহাশয়, আমরা কিছুই দেখি নাই ; আমরা জাহাজের পশ্চাৎ ভাগে ছিলাম, কলের ঘটুঘটু এবং জলের কলকল শব্দে সেখান হইতে বন্দুকের আওয়াজ শুনিবারও কোনো সম্ভাবনা छ्लि मां ।” দেশের লোককে আন্তরিক ধিক্কার দিয়া শশিভূষণ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট মকদমা চালাইলেন। সাক্ষীর কোনো আবশ্বক হইল না । ম্যানেজার স্বীকার করিল যে, সে বন্দুক ছুড়িয়াছিল। কহিল, আকাশে এক ঝাক বক উড়িতেছিল, তাহদেরই প্রতি লক্ষ করা হইয়াছিল। ষ্টিমার তখন পূর্ণবেগে চলিতেছিল এবং সেই মুহূর্তেই নদীর বাকের