পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२¢b” রবীন্দ্র-রচনাবলী তুলিয়া লইলাম। তিনি তাহাতে কোনো আপত্তি করিলেন না। কিছুক্ষণ এইরূপ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া আমার হৃদয় কেমন উজবেলিত হইয়া উঠিল, আমি বলিয়া উঠিলাম, “তোমার ভালোবাসা আমি কোনোকালে ভুলিব না।” তখনি বুঝিলাম, কথাটা বলিবার কোনো আবশ্বক ছিল না। আমার স্ত্রী হাসিয়া উঠিলেন। সে হাসিতে লজ্জা ছিল, স্থখ ছিল এবং কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস ছিল এবং উহার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে পরিহাসের তীব্রতাও ছিল। প্রতিবাদস্বরূপে একটি কথামাত্র না বলিয়া কেবল র্তাহার সেই হাসির দ্বারা জানাইলেন, “কোনোকালে ভুলিবে না, ইহা কখনো সম্ভব নহে এবং আমি তাহা প্রত্যাশাও করি না ।” ঐ স্বমিষ্ট সুতীক্ষু হাসির ভয়েই আমি কখনো আমার স্ত্রীর সঙ্গে রীতিমতো প্রেমালাপ করিতে সাহস করি নাই। অসাক্ষাতে যে-সকল কথা মনে উদয় হইত, তাহার সম্মুখে গেলেই সেগুলাকে নিতান্ত বাজে কথা বলিয়া বোধ হইত। ছাপার অক্ষরে যে-সব কথা পড়িলে দুই চক্ষু বাহিয়া দর দর ধারায় জল পড়িতে থাকে সেইগুলা মুখে বলিতে গেলে কেন যে হাস্তের উদ্রেক করে, এ পর্যন্ত বুঝিতে পারিলাম না । বাদপ্রতিবাদ কথায় চলে কিন্তু হাসির উপরে তর্ক চলে না, কাজেই চুপ করিয়া যাইতে হইল। জ্যোৎস্ব উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল, একটা কোকিল ক্রমাগতই কুহু কুহু ডাকিয়া অস্থির হইয়া গেল। আমি বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমন জ্যোৎস্নারাত্রেও কি পিকবধু বধির হইয়া আছে। বহু চিকিৎসায় আমার স্ত্রীর রোগ-উপশমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ডাক্তার বলিল, “একবার বায়ু পরিবর্তন করিয়া দেখিলে ভালো হয়।” আমি স্ত্রীকে লইয়া এলাহাবাদে গেলাম । এইখানে দক্ষিণাবাবু হঠাৎ থমকিয়া চুপ করিলেন। সন্দিগ্ধভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন, তাহার পর দুই হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া ভাবিতে লাগিলেন। আমিও চুপ করিয়া রহিলাম। কুলুঙ্গিতে কেরোসিন মিটমিটু করিয়া জলিতে লাগিল এবং নিস্তন্ধ ঘরে মশার ভন্‌ভন শব্ব স্বম্পষ্ট হইয়া উঠিল। হঠাৎ মৌন ভঙ্গ করিয়া দক্ষিণাবাৰু বলিতে আরম্ভ করিলেন— সেখানে হারান ডাক্তার আমার স্ত্রীকে চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। অবশেষে অনেককাল একভাবে কাটাইয়া ডাক্তারও বলিলেন, আমিও বুঝিলাম এবং আমার স্ত্রীও বুঝিলেন যে, তাহার ব্যামো সারিবার নহে। তাহাকে চিরক্কর হইয়াই কাটাইতে হুইবে ।