পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্রাস্তি বোধ করিতেই মনোরম সেই বকুলতলার শুভ্র পাথরের বেদীর উপর আসিয়া নিজের দুই বাহুর উপর মাথা রাখিয়া শয়ন করিল। আমিও কাছে জাসিয়া বসিলাম । সেখানে অন্ধকার আরো ঘনীভূত ; যতটুকু আকাশ দেখা যাইতেছে একেবারে তারায় আচ্ছন্ন ; তরুতলের ঝিল্লিধ্বনি যেন অনন্তগগনবক্ষচু্যত নি:শব্দতার নিয়প্রান্তে একটি শব্দের সরু পাড় বুনিয়া দিতেছে। সেদিনও বৈকালে আমি কিছু মদ খাইয়াছিলাম, মনটা বেশ একটু তরলাবস্থায় ছিল। অন্ধকার যখন চোখে সহিয়া আসিল তখন বনচ্ছায়াতলে পাণ্ডুর বর্ণে অঙ্কিত সেই শিথিল-অঞ্চল প্রাস্তকায় রমণীর আবছায়া মূর্তিটি আমার মনে এক অনিবার্য আবেগের সঞ্চার করিল। মনে হইল, ও যেন একটি ছায়া, ওকে যেন কিছুতেই দুই বাহু দিয়া ধরিতে পারিব না । এমন সময় অন্ধকার ঝাউগাছের শিখরদেশে যেন আগুন ধরিয়া উঠিল ; তাহার পরে কৃষ্ণপক্ষের জীর্ণপ্রাস্ত হলুদবর্ণ চাদ ধীরে ধীরে গাছের মাথার উপরকার আকাশে আরোহণ করিল ; সাদা পাথরের উপর সাদা শাড়িপরা সেই প্রান্তশয়ান রমণীর মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িল। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। কাছে আসিয়া দুই হাতে তাহার হাতটি তুলিয়া ধরিয়া কহিলাম, “মনোরমা, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কোনোকালে ভূলিতে পারিব না।” কথাটা বলিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম ; মনে পড়িল, ঠিক এই কথাটা আর একদিন আর কাহাকেও বলিয়াছি ! এবং সেই মুহূর্তেই বকুলগাছের শাখার উপর দিয়া ঝাউগাছের মাথার উপর দিয়া, কৃষ্ণপক্ষের পীতবর্ণ ভাঙা চাদের নীচে দিয়া গঙ্গার পূর্বপার হইতে গঙ্গার স্থদুর পশ্চিম পার পর্যন্ত হাহা— হাহা— হাহা— করিয়া অতি দ্রুতবেগে একটা হাসি বহিয়া গেল। সেটা মৰ্মভেদী হাসি কি অভ্ৰভেদী হাহাকার, বলিতে পারি না। আমি তদণ্ডেই পাথরের বেদীর উপর হইতে মূৰ্ছিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেলাম। মূৰ্ছাভঙ্গে দেখিলাম, আমার ঘরে বিছানায় শুইয়া আছি। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার হঠাৎ এমন হইল কেন ?” আমি কাপিয়া উঠিয়া বলিলাম, “শুনিতে পাও নাই, সমস্ত আকাশ ভরিয়া হাঁহ করিয়া একটা হাসি বহিয়া গেল ?” . স্ত্রী হাসিয়া কহিলেন, “সে বুঝি হাসি ? সার বাধিয়া দীর্ঘ একঝাক পাখি উড়িয়া গেল, তাহাদেরই পাখার শব্দ শুনিয়াছিলাম। তুমি এত অল্পেই ভয় পাও?”