পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २४१ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সহিত এই পরিচয়ের কথা নীলমণি অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার দিদির নিকট বর্ণনা করিল। মধ্যাহ্নে চাপকান প্যাণ্টলুন পাগড়ি পরিয়া জয়গোপাল ম্যাজিস্ট্রেটকে সেলাম করিতে গিয়াছে। অর্থী প্রত্যৰ্থী চাপরাশি কনস্টেবলে চারি দিক লোকারণ্য। সাহেব গরমের ভয়ে তাম্বুর বাহিরে খোলা ছায়ায় ক্যাম্প টেবিল পাতিয়া বসিয়াছেন এবং জয়গোপালকে চৌকিতে বসাইয়া তাহাকে স্থানীয় অবস্থা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। জয়গোপাল তাহার গ্রামবাসী সর্বসাধারণের সমক্ষে এই গৌরবের আসন অধিকার করিয়া মনে মনে স্ফীত হইতেছিল এবং মনে করিতেছিল, এই সময়ে চক্রবর্তীরা এবং নন্দীরা কেহ আসিয়া দেখিয়া যায় তো বেশ হয় ? এমন সময় নীলমণিকে সঙ্গে করিয়া অবগুণ্ঠনাবৃত একটি স্ত্রীলোক একেবারে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল । কহিল, “সাহেব, তোমার হাতে আমার এই অনাথ ভাইটিকে সমর্পণ করিলাম, তুমি ইহাকে রক্ষা করে।” সাহেব তাহার সেই পূর্বপরিচিত বৃহৎমস্তক গম্ভীরপ্রকৃতি বালকটিকে দেখিয়া এবং স্ত্রীলোকটিকে ভদ্রস্ত্রীলোক বলিয়া অকুমান করিয়া তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাড়াইলেন, কহিলেন, “আপনি তাবুতে প্রবেশ করুন।” স্ত্রীলোকটি কহিল, “আমার যাহা বলিবার অাছে আমি এইখানেই বলিব ।” জয়গোপাল বিবর্ণমুখে ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিল। কৌতুহলী গ্রামের লোকেরা পরম কৌতুক অনুভব করিয়া চারি দিকে ঘেষিয়া আসিবার উপক্রম করিল। সাহেব বেত উচাইবামাত্ৰ সকলে দৌড় দিল । তখন শশী তাহার ভ্রাতার হাত ধরিয়া সেই পিতৃমাতৃহীন বালকের সমস্ত ইতিহাস আদ্যোপাস্ত বলিয়া গেল। জয়গোপাল মধ্যে মধ্যে বাধা দিবার উপক্রম করাতে ম্যাজিস্ট্রেট রক্তবর্ণ মুখে গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “চুপ রও!” এবং বেত্রাগ্র দ্বারা তাহাকে চৌকি ছাড়িয়া সম্মুখে দাড়াইতে নির্দেশ করিয়া দিলেন। জয়গোপাল মনে মনে শশীর প্রতি গর্জন করিতে করিতে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। নীলমণি দিদির অত্যন্ত কাছে ঘেষিয়া অবাক হইয়া দাড়াইয়া শুনিতে লাগিল । শশীর কথা শেষ হইলে ম্যাজিস্ট্রেট জয়গোপালকে গুটিকতক প্রশ্ন করিলেন এবং তাহার উত্তর শুনিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শশীকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “বাছ, এ মকৰ্দমা যদিও আমার কাছে উঠতে পারে না তথাপি তুমি নিশ্চিন্ত থাকো— এ-সম্বন্ধে স্বাহ কর্তব্য আমি করিব। তুমি তোমার ভাইটিকে লইয়া নিৰ্ভয়ে বাড়ি ফিরিয়া যাইতে পার।”