পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাগানযাত্রী বোম্বাই থেকে যতবার যাত্রা করেছি জাহাজ চলতে দেরি করে নি। কলকাতার জাহাজে ৰাজার আগের রাত্রে গিয়ে বসে থাকতে হয়। এটা ভালো লাগে না। কেননা, যাত্রা করবার মানেই মনের মধ্যে চলার বেগ সঞ্চয় করা । মন যখন চলবার মুখে তখন তাকে দাড় করিয়ে রাখা, তার এক শক্তির সাঙ্গ তার আর-এক শক্তির লড়াই বাধানো । মানুষ যখন ঘরের মধ্যে জমিয়ে বসে আছে তখন বিদায়ের আয়োজনটা এইজন্যেই কষ্টকর ; কেননা, থাকার সঙ্গে যাওয়ার সন্ধিস্থলটা মনের পক্ষে মুশকিলের জায়গা— সেখানে তাকে দুই উলটাে দিক সামলাতে হয়, সে একরকমের কঠিন ব্যায়াম। বাড়ির লোকেরা সকলেই জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, বন্ধুরা ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে বিদায় দিলে, কিন্তু জাহাজ চললো না। অর্থাৎ, যারা থাকবার তারাই গেল, আর যেটা চলবার সেটাই স্থির হয়ে রইল ; বাড়ি গেল সরে, আর তরী ज्ञझेल लैंiफ़िरग्न । বিদায়মাত্রেরই একটা ব্যথা আছে ; সে ব্যথাটার প্রধান কারণ এই, জীবনে যাকিছুকে সব-চেয়ে নির্দিষ্ট করে পাওয়া গেছে তাকে অনির্দিষ্টের আড়ালে সমৰ্পণ করে যাওয়া । তার বদলে হাতে হাতে আর-একটা কিছুকে পাওয়া না গেলে এই শূন্ততাটাই মনের মধ্যে বোঝা হয়ে দাড়ায় । সেই পাওনাটা হচ্ছে অনির্দিষ্টকে ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্টের ভাণ্ডারের মধ্যে পেয়ে চলতে থাকা । অপরিচয়কে ক্রমে ক্রমে পরিচয়ের কোঠার মধ্যে ভূক্ত করে নিতে থাকা । সেইজন্তে যাত্রার মধ্যে ষে দুঃখ আছে চলাটাই হচ্ছে তার ওষুধ । কিন্তু, যাত্রা করলুম অথচ চললুম না, এটা সহ করা শক্ত । অচল জাহাজের ক্যাবিন হচ্ছে বন্ধনদশার দ্বিগুণ-চোলাই-করা কড়া আরক। জাহাজ চলে বলেই তার কামরার সংকীর্ণতাকে আমরা ক্ষমা করি। কিন্তু, জাহাজ যখন স্থির থাকে তখন ক্যাবিনে স্থির থাকা, মৃত্যুর ঢাকনাটার নীচে আবার গোরের ঢাকনার মতো । i